১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজ সংলগ্ন পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখোমুখি পালটা অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারটি কোম্পানি ব্রাভো, ডেলটা, আলফা ও চার্লি। ব্রাভো কোম্পানিতেই ছিলেন ফয়েজ আহমদ। সেদিন মর্টারের গোলা শেষ হয়ে গেলেও মেশিনগান, হালকা মেশিনগান প্রভৃতি হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানিদের দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করছিলেন ফয়েজ আহমদসহ গণযোদ্ধারা। হঠাৎ একটি গোলা এসে লাগে সুবেদার ফয়েজ আহমদের গায়ে। শহীদ হন রণাঙ্গনের এ অকুতোভয় বীর যোদ্ধা।

পরশুরামের বীর সন্তান :
সুবেদার ফয়েজ আহমদের জন্ম ১৯৪০ সালে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার পশ্চিম অলকা গ্রামের মাষ্টারবাড়িতে। তার পিতার নাম জাবেদ আলী। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তিনি ১৯৬৮ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম জাহানারা বেগম। তখন তিনি ছিলেন অন্তঃস্বত্তা। ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন ফয়েজ আহমদ। ২৯ মার্চ তাদের রেজিমেন্ট পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আক্রান্ত হয়। এরপর তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার মাত্র তিন দিন আগে ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সিলেটের এমসি কলেজের উত্তর পাশে হানাদারদের সাথে সম্মুখ সমরে লড়তে লড়তে শহীদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে প্রদত্ত গেজেট অনুযায়ী তার খেতাব গেজেট নম্বর ৩৭।

প্রথম প্রতিরোধ যশোর ক্যান্টনমেন্টে :
১৯৭১ সালে সুবেদার ফয়েজ আহমদ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের আক্রমণ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার জন্য ব্যাটালিয়নের অর্ধেক সেনাকে ছুটিতে পাঠানো হয়। বাকিদের বেনাপোল সীমান্ত এলাকার জগদীশপুর গ্রামে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। এ সময় রেডিও শোনা নিষিদ্ধ থাকায় ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদারদের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেননি বাঙালি সেনারা। পরে ২৯ মার্চ ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দূরদানি প্রশিক্ষণরত সেনাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফিরতে বললে তারা রাতের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যান। ৩০ মার্চ ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হলে বাঙালি সেনারা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে পজিশন নেন। ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অবাঙালি সেনারা বাঙালি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালালে মধ্যরাতে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে সুবেদার ফয়েজ আহমদসহ বাঙালি সেনারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ৩১ মার্চ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালালে বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা শহীদ হন। গোলাগুলি কমে আসলে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কাভারিং ফাইটের সাহায্যে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যান সুবেদার ফয়েজ আহমদসহ বাঙালি সেনারা। এরপর তারা চৌগাছা বাজারে গিয়ে একসঙ্গে হন। চৌগাছা যশোর সড়কের উপর সলুয়া বাজারে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সুবেদার ফয়েজ আহমদ।

পরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন গ্রামগুলোতে সুবেদার ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে তার প্লাটুনের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৪ এপ্রিল তার নেতৃত্বে কাগজপুকুরে অবস্থান নিয়েছিলেন ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গলের ৫০০ সেনা। ২৩ এপ্রিল কাগজপুকুর যুদ্ধের পর ভারতে চলে যান সুবেদার ফয়েজ আহমদ ও তার অধীনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। পরে মে মাসের মাঝামাঝিতে ক্যাপ্টেন হাফিজকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হয় এবং মে মাসের শেষ সপ্তাহে সুবেদার ফয়েজ আহমদ পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে চলে যান মেঘালয়ের তুরায়।

কেজুরিছড়া চা বাগানে প্রথম অভিযান :
 অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দিয়ে সিলেটের চা বাগানগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়। সুবেদার ফয়েজ আহমদ প্রথম অভিযান চালান কেজুরিছড়া চা বাগানে। ১৫ অক্টোবর  সিলেটের ফুলতলা সাগরনাল চা বাগান রেইড, ২৮ অক্টোবরের ধলই বিওপি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নভেম্বরে আটগ্রাম-চারখাই-সিলেট ধরে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আটগ্রাম ও চারগ্রাম দখল করেন সুবেদার ফয়েজ আহমেদসহ মুক্তিযোদ্ধারা।

শহীদ হন সিলেট এমসি কলেজ যুদ্ধে :
৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে সিলেট দখলের পরিকল্পনা করা হয়। তখন পাকিস্তানি বাহিনী দরবস্ত ও খাদিমনগর এলাকায় অবস্থান নিলে সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিবাহিনী কানাইঘাট-চরখাই হয়ে সিলেট দরবস্ত সড়কে উঠবে। এরপর টানা ৩ দিন পায়ে হেঁটে ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সিলেটের এমসি কলেজের উত্তর পাশে হানাদারদের শক্ত ঘাঁটির ৫০০ গজ দূরত্বের মধ্যে পৌঁছায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি। এ সময় ব্রাভো কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে প্রতিরোধব্যুহ গড়ে তোলেন সুবেদার ফয়েজ আহমদ। তার পেছনে ছিল ক্যাপ্টেন নূরের আলফা ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর ডেল্টা কোম্পানি। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করলে ২৫ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করে তাদের মরদেহগুলো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ব্রাভো কোম্পানি আক্রমণের তীব্রতা বাড়ায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবুও সুবেদার ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে তার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান, হালকা মেশিনগান ও রাইফেলের সাহায্যে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পরে মিত্রবাহিনীর বিমান আকাশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে হামলা চালালে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেদিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাঁদের শতাধিক সেনা নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানির ২০ জন সদস্য শহীদ এবং ২৪-২৫ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে সুবেদার ফয়েজ আহমদও ছিলেন। তিনি অসীম সাহস ও রণকৌশল দেখিয়ে শহীদ হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খন্ডের ৫০৩ পৃষ্ঠায় ব্র্যাভো কোম্পানীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের জবানবন্দীতে সেদিনের বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-
‘একটানা হাঁটার ফলে আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও বিপুল উৎসাহ এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা চা বাগানের ভিতর প্রবেশ করি। ‘চিকনাগুল’ চা বাগানে আমরা মোজাহিদ কোম্পানীকে লেফট্যানেন্ট মুদাসসির-এর নেতৃত্বে রেখে হেলিকপ্টারযোগে খাদ্যদ্রব্য এবং রসদ সংগ্রহ করার জন্য। ওয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজ দেওয়া সত্ত্বেও আমরা কোন সাহায্য পেলাম না। শত্রুপক্ষ কালগুল চা বাগানে আমাদেরকে বাধা প্রদান করে এবং আমাদের অল্প কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। তখন আমরা এ শত্রু ঘাঁটি এড়িয়ে যাই এবং ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহরে ঢুকে এম, সি, কলেজ এলাকায় প্রবেশ করি। এম.সি কলেজে শত্রুর অত্যন্ত শক্ত ঘাঁটি ছিল। আমরা শত্রুপক্ষ থেকে পাঁচশত গজ দূরে এম, সি, কলেজের উত্তর দিকে টিলাগুলোর উপর ডিফেন্স নিই। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে ছিল ‘বি’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী- যথাক্রমে আমার এবং ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে। পিছনে ‘বি’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী যথাক্রমে ক্যাপ্টেন নূর এবং লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ মেজর জিয়াউর রহমান এ চার কোম্পানীর মাঝামাঝি একটি টিলার উপর অবস্থান করছিলেন। আমাদের সাথে মিত্রবাহিনী আর্টিলারীর একজন ব্যাটারী কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু অয়ারলেস সেটের মাধ্যমে তিনি তাঁর গান পজিশনের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হন। এ সময় আমাদের ৩ ইঞ্চি মর্টারের মাত্র ১৪টি গোলা অবশিষ্ট ছিল। প্রায় তিনদিন আমাদের সৈন্যরা বলতে গেলে অনাহারে ছিল, তথাপি শত্রুর নাকের ডগায় ট্রেঞ্জ খুঁড়ে পজিশন নিতে থাকে। শত্রুপক্ষ আমাদের অতি নিকটে ছিল এবং নির্বিকারে কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে আমরা মুক্তিবাহিনীর দল। কারণ আমাদের পোশাক, স্টীল হেলমেট। অস্ত্রশস্ত্র তাদের মতই ছিল। তাছাড়া এ সময় যুদ্ধ চলছিল আমাদের পিছনে এবং বাঁ দিকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে খাদেমনগরে। আমরা শত্রুপক্ষের পজিশনের ভেতর দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করব তা ভাবতেও পারিনি। একটু পরে চিৎকার করে তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমরা তাদের চিৎকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ ট্রেঞ্চ খুঁড়তে থাকি। এ সময় ‘ডি’ কোম্পানীর পজিশনের সামনের রাস্তায় একটি আর্টিলারী গান ও দুটি জিপের কনভয় থামে। তখন ‘ডি’ কোম্পানীর কমান্ডার মর্টারের সাহায্যে উক্ত কনভয়ের উপর গোলাবর্ষণ করেন, যার ফলে একটি জীপে আগুন ধরে যায়। শত্রু তখন আমাদের ওপর সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-সেদিক চলাফেরা করতে থাকে। এ সুযোগে আমরা মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগান দিয়ে তাদের ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। ফলে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য রাস্তার উপরেই হতাহত হয়। শত্রুপক্ষ তখন মর্টারের সাহায্যে আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে মৃতদেহ সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আমাদের নিখুত গুলিবর্ষণের ফলে শত্রুপক্ষের আরও বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়। দুপুরের সময় শত্রুরা বাধ্য হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এবং মর্টারের প্রবল গোলাবর্ষণের সাহায্যে আমাদের কোম্পানীর (‘বি’ কোম্পানী) ওপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। অল্প কিছুনের মধ্যেই আমাদের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবু আমরা মেশিনগান, হালকা মেশিনগান, এবং রাইফেলের সাহায্যে দৃঢ়তার সাথে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করি। এ আক্রমণের ফলে পাকবাহিনীর প্রায় ৮০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। আমাদের ‘বি’ কোম্পানী এবং ‘ডি’ কোম্পানীর মোট ২০ জন সৈন্য শহীদ হন এবং প্রায় ২০ জন গুরুতরভাবে আহত হন। আমার কোম্পানীর সবচেয়ে সুযোগ্য সুবেদার ফয়েজ আহমদ অসীম সাহস এবং রণকৌশল প্রদর্শন করে শহীদ হন। তাঁকে “বীর উত্তম” খেতাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

৪২ বছর পর মেলে শহীদ ফয়েজের কবর:
যুদ্ধের ৪২ বছর পর গত ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর সিলেটের টিলাগড় এমসি কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি গণকবর চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব এলাকায় মাটির নিচ থেকে পাওয়া কংকাল ও হাড়গোড়ের বিস্তর গবেষণার পর এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে কবরগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও বাঁধাই করা হয়। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের দিন অনানুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হয় কবরগুলো। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কের পাশে টিলার পাদদেশে একস্থানে মোট ৭টি, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনের টিলার পাদদেশে দু’টি এবং জেলা দুগ্ধ খামারের ভিতরে একটি গণকবর রয়েছে। সবগুলো কবরেই সাদা টাইলস দিয়ে বাঁধাই করা। তার মধ্যে একটি হচ্ছে শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহমদের। টিলাগড় পয়েন্ট থেকে শুরু করে কবরগুলোর পাশ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দিকনির্দেশক সাইনবোর্ডও লাগিয়েছে সেনাবাহিনী। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে-  মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কবর/সমাধিস্থল-  
‘এখানে শায়িত আছেন সিলেট এমসি রণাঙ্গনে যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এক রক্তয়ী যুদ্ধে ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানির সৈনিকরা এখানে শাহাদাৎ বরণ করেন।

শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহমেদকে মরনোত্তর ‘বীর উত্তম’ ও শহীদ নায়েক মো: আফসাল আলী কে মরনোত্তর ‘বীর বিক্রম’ উপাধি দেওয়া হয়।’ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল (১৯৯৬-২০০১) সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকবর চিহ্নিত করতে কাজ শুরু করে। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও গবেষণার মাধ্যমে এ গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

স্মৃতির আড়ালে ফয়েজ আহমদ
এমসি কলেজ যুদ্ধে অসীম সাহস ও রণকৌশল দেখিয়েছেন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন ফয়েজ আহমদ। তাঁর কবরও সেখানে দেয়া হয়েছে। এদিকে পরশুরামের চিথলিয়া ইউনিয়নের অলকা গ্রামের বাড়িতে তাঁর বাবা-মার কাছে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জাহানারা বেগম।
 ২০১৭ সালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ফেনী জেলা প্রশাসনের বিশেষ প্রকাশনা ‘একাত্তরের ফেনী’তে ফয়েজ আহমদকে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু তাহের লেখেন, ২০১১ সালে (তারিখ মনে নেই) একদিন বীর উত্তম ফয়েজ আহমদের খোঁজে পরশুরামের অলকা গ্রামে গিয়ে হাজির হলাম। গ্রামের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ মাথা তোলা লোকদের কাছে বীর উত্তম ফয়েজ আহমদের বাড়ির অবস্থান জানতে চাইলাম। অনেক খোঁজাখুজি হলো। ৪০ বছরের কম বয়সের কেউ তাঁর নামও শোনেন নি। পরে দুইজন বৃদ্ধ মানুষ এগিয়ে এসে বললেন- ‘৭১ সালের যুদ্ধে সেনাবাহিনীর একটা লোক মারা গেলে মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর লোকজন এখনো তাঁর বাড়ি আসা যাওয়া করেন। তাদের সাহায্যে ফয়েজের বাড়ির অবস্থান জানা গেল। খানাখন্দে ভরা গ্রামের কাঁচা সরু রাস্তা দিয়ে বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। বাড়িতে শুধু ফয়েজের স্ত্রী ছিলেন। এ সময় আরও কয়েকজন প্রতিবেশী এগিয়ে এলেন। তাঁর স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ফয়েজের একমাত্র ছেলে যিনি জীবনে কোনদিন বাবাকে দেখেননি- বর্তমানে সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেন। স্বাধীনতার পর ফয়েজের শ্বশুর মেয়ের জামাইয়ের খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রীকে বাপের বাড়ি নিয়ে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফয়েজের বাবা জাবেদ আলী তাঁর নাতির লালন পালনের কথা চিন্তা করে ছেলের বৌকে নিজ বাড়িতে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে ছোট ছেলের (দেবর) সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও ইতোমধ্যে মারা গেছেন। দুই স্বামীর ঘরে দুই সন্তান নিয়েই তিনি আছেন। ফয়েজের বাড়ি থেকে পরশুরাম ফিরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ উপজেলা পর্যায়ের নেতাদেরকে ফয়েজের কথা জানালাম। তার আগে তাঁরাও জানতেন না ওই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ফয়েজ আহমদ নামে একজন মানুষ ছিলেন। গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান-নেতাদের বাড়ির রাস্তাও পাকা হয়েছে। কিন্তু একজন বীর উত্তম এর বাড়ির রাস্তা পাকাকরণ তো দূরের কথা নামটাও কেউ জানতেন না।’

* শহীদ ফয়েজ আহমদের ছবি পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যদের বর্ণনা অনুযায়ী ছবি আঁকা হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক ফেনী প্রকাশিত ‘খেতাবপ্রাপ্ত ফেনীর ৩১ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বই থেকে সংকলিত