করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের সব সেক্টরেই হ-য-ব-র-ল। সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যেই সেটি পরিষ্কার হল। স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয় বর্তমান সংকট মোকাবেলা কমিটির চেয়ারম্যান। কিন্তু উনি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে বললেন, সব সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয় না, এমনকি ওনাদের থেকে পরামর্শও নেয় না।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে অন্যতম কাজ হচ্ছে সামাজিক বা পারস্পরিক দূরত্ব মেনে চলা। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলেও সত্য আমরা এখনও এটি মেনে চলতে পারছি না। সেটার জন্য রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ যেমন দায়ী, সমানভাবে আমরা নাগরিকরাও দায়ী।

আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো, ব্যাংক গুলোতে, কাঁচাবাজারে এত জনসমাগম, মনে হচ্ছে ঈদ উৎসব। এটি কেন হয়েছে? কারণ আমরা সময় বেধে দিয়েছি, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। সময় কমিয়ে দেয়াতে সব মানুষ এই সময়ে ভিড় করছে। আর আমরা নাগরিকরাও অসচেতন, প্রয়োজন ছাড়াও ভিড় করছি। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন, সময়টা আরও বাড়ানো এবং প্রতিটি বাজারে বা লোকালয়ে ২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে নিয়োজিত করা, পাশাপাশি স্বল্পসংখ্যক সদস্য দিয়ে নিয়মিত টহল অব্যাহত রাখা। বিশাল বহর নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল এখন প্রয়োজন নেই।

আমরা আরও দেখেছি সরকারি ছুটি ঘোষণার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ দল বেঁধে, গাদাগাদি করে গ্রামে গেল। আবার হঠাৎ গার্মেন্টস খুলে দেয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক গাদাগাদি করে ঢাকায় আসলো। এখানে বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় সমন্বয়হীনতা লক্ষ্যণীয়। তাই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।

এবার আসুন হঠাৎ হসপিটালে ডাক্তার কমে যাওয়া এবং জ্বর কাশি, শ্বাসকষ্ট জনিত রোগীদের সব হসপিটালে ভর্তি নিতে অপারগতার কারণ কি?

১. চিকিৎসকদের সঠিক সময়ে পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ না করা। এমনকি এখনও অনেক চিকিৎসক পিপিই পায়নি। যারা সংগ্রহ করেছেন অধিকাংশই নিজের প্রচেষ্টায় করেছেন।
২. প্রাইভেট চেম্বারের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা না থাকা।
৩. বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নেতৃত্বহীন, অভিভাবকহীন। চিকিৎসক সংগঠন গুলো ও নেতারা, বিশেষ করে বি এম এ সঠিক ভুমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
৪. সারাদেশে বিশেষ করে প্রত্যেক জেলা শহরে করোনা নির্ণয় করতে টেস্ট এর ব্যবস্থা না করা। কারণ টেস্ট না করলে বুঝার উপায় নেই, এটা কি কোভিড-১৯? নাকি সাধারণ জ্বর কাশি ও নিউমোনিয়া? তাই চিকিৎসা দেওয়াও এইক্ষেত্রে কঠিন।
৫. কিছু চিকিৎসক উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছাড়া নিজেই চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন, যেটা এই সংকট মুহূর্তে না করলে ভালো হত। যদিও অনেকেই মহৎ চিন্তা থেকে এটি করেছেন যে, চেম্বার করলে জনসমাগম হবে, এতে ভাইরাস সংক্রমণ বাড়বে। কিন্তু আমরা নিজেরা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে এখন আমাদের ডাক্তারদের উপর দোষ চাপানো সহজ হচ্ছে।
৬. আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতা বা দূর্বলতাও ছিল, যেটা আমাদের জন্য নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে সঠিক গাইডলাইন না থাকাও কিছুটা দায়ী এবং কিছুটা ব্যক্তিগত দূর্বলতাও দায়ী।

এমন পরিস্থিতিতে যদি চিকিৎসকদের নিয়ে নিয়মিত নেগেটিভ নিউজ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ প্রকাশ করা, দায়িত্বশীল ব্যক্তি পর্যায় থেকে হুমকিসূলভ কথা বলা হয়, তাহলে তো চিকিৎসকরা সাহস ও কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। এবং চিকিৎসক এবং রোগীদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করবে। যা সংকট কে আরও বাড়াবে।

তাই আসুন এই মুহূর্তে চিকিৎসক দের প্রতি বিদ্বেষ নয়, চিকিৎসকদের উৎসাহ দিন, সাহস দিন। ইনশাআল্লাহ চিকিৎসকরা নিজের জীবন দিয়ে হলেও আপনাদের পাশে থাকবেন।

এই মুহূর্তে শুধু রাষ্ট্রের সমালোচনা নয়, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনাও মেনে চলতে হবে। সকলকে দলমত নির্বিশেষে সংকট মোকাবেলায় কাজ করা জরুরী।

 

লেখকঃ

ডা.মঞ্জুর আহমেদ সাকি
এমবিবিএস
(জেনারেল ফিজিশিয়ান)
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর,
নিউ ভিশন মডেল হসপিটাল, কুমিল্লা।