পরীক্ষায় ফেল মানেই কি জীবনের সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া; নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর আরও অনেক উপায় আছে? আত্মহত্যার সরাসরি কারণ?অভিভাবকের ভুল ধারণা, মেধা, অন্যের সাথে নেতিবাচক তুলনা, অমনোযোগী শিক্ষার্থী ও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় এমনই অনেক প্রশ্ন রয়েছে অভিভাবকদের। সে বিষয় নিয়ে লিখেছেন ফেনী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক শিহাব উদ্দীন।

প্রতি বছর এক একটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবার পর থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের দেশে প্রায় ২০ থেকে ৫০ জন পরীক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। কিছু কিছু পরীক্ষার্থী বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কোন কোন পরিবারে চলে ঝগড়া বিবাদ।

আগামী ৩১ মে এসএসসি পরীক্ষা ২০২০ এর ফলাফল প্রকাশিত হওয়া কথা রয়েছে। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করবে। কেউ কেউ প্রত্যাশার চেয়ে ভালো রেজাল্ট পাবে। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু আমরা যতই শুভকামনা করি না কেন কিছু পরীক্ষার্থী ফেল করবে। অনেকে প্রত্যাশিত A+ পাবে না। কিন্তু শুধু একটি পরীক্ষার ফলাফল জীবনের সবকিছু নয়। মূলত এটি এমন কিছু নয় যে এর জন্য ঝগড়া বিবাদ বা আত্মহত্যার পথে যেতে হবে।

  • আত্মহত্যার সরাসরি কারণঃএকজন পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার পেছনে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি কারণ কাজ করে। তবে অভিভাবকদের বিরূপ আচরণ একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দেয় যা তার আত্মহত্যার সরাসরি কারণ। সন্তান A+ না পাওয়ায় বা ফেল করায় অনেক মা কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেন; বাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ করে না খেয়ে রাত কাটান। কোন কোন পিতা ঘরে এসে রেজাল্ট শুনে জিনিসপত্র ভাংচুর শুরু করে দেন। কেউ কেউ বলেন, ফেল করলে/ A+ না পেলে বাড়িতে জায়গা হবে না ; তোর মত সন্তান থাকার চেয়ে না থাকা ভালো; ফেল করলে পড়াশুনা শেষ, বিয়ে দিয়ে দেব অমুকের সাথে (যার বয়স ৩৫)।

 

  • অভিভাবকের ভুল ধারণাঃআপনি চান যেভাবেই হোক আপনার সন্তানকে A+(৮০% নম্বর) পেতে হবে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন তো আপনি কি ছাত্রজীবনে ফার্স্ট ডিভিশন(৬০% নম্বর) পেয়েছিলেন? আপনি বলবেন আপনাদের সময় পড়াশোনা কঠিন ছিল, আপনার পিতামাতা পড়াশোনার সব সুবিধা আপনাকে দিতে পারেন নি, ইত্যাদি। ভাবুন তো আপনার সময় বই/বিষয় কয়টা ছিল আর এখন কয়টা। আপনার চেয়ে আপনার সন্তানকে কি বেশি বই পড়তে হচ্ছে না? আপনার সময়ে বইয়ের সাইজ ছিল ছোট। এখন বইয়ের স্বাস্থ্য বছর বছর মোটা হচ্ছে। আপনার সময় আপনি বইয়ের তিনভাগের দুইভাগ বা দুইভাগের একভাগ পড়ে পরীক্ষায় ফুল আন্সার দিতে পারতেন। এখন সম্পূর্ণ বই না পড়ে ফুল আন্সার দেয়া সম্ভব না। আপনি বইতে যা পড়তেন পরীক্ষায় সরাসরি তা লিখতেন। এখন আপনার সন্তান শত শত অংক শিখেও পরীক্ষায় একটা অংকও হুবহু কমন পায় না। নব্বই এর দশকে বেশ কয়েক বছর MCQ এর প্রশ্নব্যাংকও ছিল। ৫০০ টি নির্দিষ্ট MCQ ছিল যেখান থেকে পরীক্ষায় নিশ্চিত ৫০ টি চলে আসত। আর MCQ, রচনামূলক মিলে ৩৩ পেলে ছিল পাস, ৬০% নম্বর পেলে ছিল ফার্স্ট ডিভিশন। তাহলে পড়াশোনা এখন সহজ হল কীভাবে? অবশ্য এখন আগের চেয়ে নম্বর বেশি দেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আগে মনে করা হত যতই ভালো লেখা হোক একটা প্রশ্নের উত্তরে ১০ এ ১০ দেয়া যায় না। এখন সে মানসিকতা নেই। ভালো লিখলে ফুল মার্কস দিতে হবে; এটা পরীক্ষার্থীর প্রাপ্য। সে যত ভুল লিখবে তত নম্বর কমতে থাকবে।

 

  • মেধা মূলত জন্মগতঃ
    আপনি আপনার সন্তানের পেছনে এক বা একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। কিন্তু হয়তো তার ভালো মেধা নাই। আর মেধাতো মূলত বংশগতভাবে পেয়ে থাকে। তাহলে আপনি সন্তানকে দোষ দিবেন কেন?

 

  • অন্যের সাথে নেতিবাচক তুলনা নয়ঃ
    আপনি অভিযোগ করেন, অমুকের ছেলে A+ পেয়েছে, তুই কেন পাস না? অমুকের মেয়ে ৯৮% নম্বর পেয়েছে, তুই কেন পাবি না? এ ধরনের তুলনা শিশুদের মনে আঘাত দেয়। আচ্ছা, আপনাকে যদি অন্যের সাথে তুলনা করা হয়, আপনার কি ভালো লাগবে? আপনার স্বামী যদি আপনাকে বলেন, 'অমুকের বউয়ের রান্না এত মজা, তুমি তার পা ধুয়ে পানি খেতে পার না?'- কেমন লাগবে আপনার? আপনার স্ত্রী যদি আপনাকে বলেন, 'অমুকের স্বামী কত সুন্দর করে কথা বলেন! মাসে লাখ টাকা ইনকাম করেন, তুমি পার না কেন?' কেমন লাগবে আপনার? (sorry for using bad language)

 

  • অমনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের সম্বন্ধেঃ
    বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন পড়াশোনায় এতই খারাপ ছিলেন যে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। স্কুল থেকে দেয়া চিঠিতে লেখা ছিল, "টমাস পড়াশোনায় খুবই অমনোযোগী এবং তার মেধাও ভালো নয়। এ ধরনের ছাত্রকে স্কুলে রাখা সম্ভব না।" কিন্তু টমাসের মা চিঠি খুলে ছেলেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন, "টমাসের মেধা সাধারণ ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি। এমন মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর ক্ষমতা সাধারণ স্কুলের নেই। অতএব, তাকে যেন বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করানো হয়।" মায়ের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে টমাস জটিল জটিল বিষয় পড়া শুরু করেন। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি দশ হাজার বার পরীক্ষা করে ব্যর্থ হন কিন্তু থামেন নি। কারণ তার মা তার মধ্যে এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছলেন যে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। মায়ের মৃত্যুর পর টমাস স্কুলের সেই চিঠিটি খুঁজে পেয়েছিলেন। চিঠিটি পড়ে তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন, "টমাস ছিল একজন মেধাহীন শিশু। একজন অসাধারণ মায়ের অনুপ্রেরণায় সে হয়ে উঠে যুগের সেরা মেধাবী।"

অতএব, অমনোযোগী ছেলেমেয়েদের বার বার পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝান। তাদেরকে উৎসাহিত করুন। পড়াশোনা করে যারা সফল হয়েছেন তাদের উদাহরণ দিন। পড়াশোনা না করে যারা কষ্টে ও অভাবে আছেন তাদের উদাহরণ দিন। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের বই রাখুন। সময়ে সময়ে নতুন বই কিনুন। আপনিও বই পড়ুন। এতে বইয়ের প্রতি আপনার সন্তানের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। আপনি সুযোগ পেলেই ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবেন, টিভির সিরিয়াল আর রান্নার অনুষ্ঠান দেখবেন আর আপনার সন্তান হবে বই প্রেমিক--এমন আশা করা যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে, মারধর করে শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় আগ্রহী করা যায় না। সন্তানকে পড়ার জন্য মারলে সে মনে করবে পড়া তার শত্রু, বই তার শত্রু। আর শত্রুকে তো সে আপন করে নিতে পারবে না। তার মানে, বুঝিয়ে না হলে তাকে মারধর করেও হবে না।

  • দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীরা, বলেছি মেধা মূলত জন্মগত। কিন্তু তুমি পরিশ্রম করে তোমার দুর্বল মেধাকে উন্নত করতে পার। আমার এক স্যার বলেছিলেন, এক এক মানুষের এক এক বয়সে মস্তিষ্কের নিউরন বিকশিত হয়। আর পরিশ্রম করে যে নিউরনকে বিকশিত করা যায় তার প্রমাণ আমি নিজেই। আমিও কিন্তু তেমন মেধা নিয়ে জন্ম নিই নি। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে আমার রোলনম্বর থাকত সবসময় ৬০/৭০ এর পরে। হাই স্কুলে গিয়ে একটু পরিশ্রম শুরু করি। দেখি সিক্সের সাময়িক পরীক্ষায় ৮ নম্বরে পাস করি। সিক্স থেকে সেভেনে উঠি ৭ নম্বর হয়ে। সেভেন থেকে এইটে ৫ নম্বর। এইট থেকে নাইনে ৪ নম্বর। নাইন থেকে টেনে ৩ নম্বর। কলেজে গিয়ে ফার্স্ট। এরপর ছাত্রজীবনে আমাকে আর সেকেন্ড হতে হয় নি। পরিশ্রম করে তুমি মেধাবীদেরকেও পিছনে ফেলে দিতে পার।

 

  • একটা পরীক্ষার ফলাফল ভবিষ্যত নির্ধারণ করে নাঃ
    A+ না পেলে বা পরীক্ষায় ফেল করলে যে জীবন শেষ তা নয়। হয়তো আপনার সন্তান মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ থেকে একধাপ পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হয়তো সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যে আরো ভালো কিছু রেখেছেন। হয়তো A+ মিস করে আপনার সন্তান নামিদামি কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। তাতে কিছুই আসে যায় না। মেডিকেল বা ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় বা সরকারি চাকুরির পরীক্ষায় কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা হয়েছে সেটা দেখা হয় না; একজন ব্যক্তি কি জ্ঞান অর্জন করেছে সেটা দেখা হয়। আর আশেপাশে তাকান। যারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত তাদের সবাই কি ছাত্রজীবনে ভালো রেজাল্টধারী? তাহলে আপনি কেন একটা A+ এর জন্য মাথা ফাটাবেন? আপনার সন্তান A+ পায় নি। হয়তো কয়েক ডজন A+ধারী আপনার সন্তানের অধীনে চাকুরি করবেন। এমন উদাহরণও বাস্তবে অনেক।

 

  • ঘুরে দাঁড়াতে হবেঃ
    সএসসি ও এইসএসসিতে A+ বা ফার্স্ট ডিভিশন মিস করে ডাক্তার হয়েছেন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন বা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন এমন উদাহরণ অসংখ্য। এবার হয়তো তুমি তোমার প্রত্যাশিত ফলাফল পাবে না। হয়তো ফেল করবে। Failures are but pillars of success. হাল ছাড়া যাবে না। লোকে কি বলে সেটা ভেবে নিজেকে আড়াল করা যাবে না বা শেষ করা যাবে না। নিজের সমস্যা, ত্রুটি বের কর। তারপর আগের চেয়ে কয়েকগুণ পরিশ্রম কর। সহজে জেতার আনন্দ কোথায়? বাধা যত বিশাল, বিজয়ের আনন্দও তত বাঁধভাঙা। ব্যর্থ হওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়। ব্যর্থতা নতুন করে শুরু করার প্রেরণা। হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই হেরে যাওয়া। বিশ্বখ্যাত আলিবাবা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা জীবনে অনেক পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, অনেক চাকুরির পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েছিলেন, কিন্তু হাল ছাড়েন নি। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন, "আমাকে আমার সফলতা দ্বারা বিচার করো না। ব্যর্থতা থেকে কতবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি তা দিয়ে আমাকে বিচার করো।"

শেষ কথাঃ
পড়াশোনার পাশাপাশি আপনার সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দিকেও অবশ্যই গুরুত্ব দিন। শারীরিক বিকাশের জন্য মাঠের খেলাধূলা বা ব্যায়াম আবশ্যক। কিছুটা বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। সর্বোপরি, সন্তানকে ধনী লোক নয়, ভালো মানুষ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি । ভালো মানুষ না হয়ে শুধু ধনী হলে আপনি একসময় কষ্ট পাবেন। ওই যে একটা গান আছে না "ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার...."?

 

লেখক: শিহাব উদ্দীন
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ