গত ৫/৬দিন আগের এক রাতে রেজাল্ট আসার পর দলবল নিয়ে এক করোনা শনাক্ত রোগীর বাড়ি লকডাউন করতে গেছেন তিনি। গভীর রাতে তাদের উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে গেল গ্রামবাসী। মাইকে ঘোষণা দিল তারা, ‘গ্রামে ডাকাত পড়েছে’। পরে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সেই বাড়ি লকডাউন করে ফিরলেন ঘরে।


এভাবেই নানা প্রতিবন্ধকতা ও পরস্থিতি সামলে নিয়ে একটি ফুলকে বাঁচাতে বিরামহীন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রুবাইয়েত বিন করিম ও তার দল। কথা প্রসঙ্গে এ ঘটনার কথা জানান তিনি। শুধু তাই নয় সকল বিপদ তুচ্ছ করে জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি ও তার দল। তবে এখন পর্যন্ত উপজেলায় কোন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হননি।


ডাঃ রুবাইয়েত বিন করিম বলেন, অবশ্য মানুষের দোষ নেই। রেজাল্ট আসে রাতে। তাই লকডাউন করতে দেরি হয়ে যায়।


সকালে ভোরে এসে হাজির হই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। নিয়মিত রোগীর চিকিৎসা দিয়ে শুরু হয় দিনের কার্যক্রম। এরপর বের হই উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে। করোনা রোগীদের তদারকি ও পরামর্শ দিতে আক্রান্তদের বাড়িতে যেতে হয়। তারপর দিনের বিভিন্ন সময় কাটে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাছাড়া করোনা উপসর্গ থাকাও রোগীরা বাদ যায় না। তারপর রাতে রেজাল্ট পেলে আবার ছুটতে হয় শনাক্তকৃতদের বাড়ি লকডাউন করে তাদের পরামর্শ দিতে। দিনরাত ২৪ ঘন্টার বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছি। গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে গড়ে ১শ জন রোগী আসেন বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা নিতে। তাদেরও সময় দিতে হয়।


উপজেলায় করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতির শুরু থেকেই এভাবে দিনরাত কাজ করে চলেছেন ডাঃ রুবাইয়েত বিন করিম।


দলে আরও রয়েছেন ল্যাব টেকনেশিয়ান শামসুল আলম সুমন, মোয়াজ্জেম হোসেন মজনু, এমটি (ইপিআই) আবদুর নূর, এইচআই ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম ও এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার দিলীপ কুমার দাস।


উপজেলায় সংক্রমণের হার বাড়ার সম্পর্কে ডাঃ রুবাইয়েত বিন করিম জানান, আমাদের নমুনা সংগ্রহের হার অনেক বেশি। তাই শনাক্তের সংখ্যাও বেশি। নমুনা সংগ্রহের সংখ্যায় আমাদের ধারে কাছে জেলার অন্য কেউ নেই।


তিনি বলেন, আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছে। উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নের সবকয়টিতেই করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত উপজেলায় মোট শনাক্তকৃত ব্যক্তির সংখ্যা ৫৭জন। আজ পর্যন্ত ৫৯৫টি সংগৃহীত নমুনার মধ্যে ৪৬৬টির ফলাফল পেয়েছি।


তিনি জানান, শনাক্তকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পৌরসভায় ১৯জন, রাজাপুরে ১২জন, সিন্দুরপুরে ২জন, পূর্বচন্দ্রপুরে ৬জন, রামনগরে ১জন, ইয়াকুবপুরে ৬জন, দাগনভূঞা সদর ইউনিয়নে ৫জন, মাতুভূঞা ১জন, জায়লস্করে ৩জন রয়েছে। এছাড়া উপজেলার বাইরে বাসিন্দা ২ জনের নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে। আক্রান্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত উপজেলায় মোট ১০জন সুস্থ হয়েছেন।


জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত ফেনীতে মোট ১৯৩জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত করা হয়েছে ফেনী সদরের ৭১জন। এরপরে রয়েছে দাগনভূঞা ৫৭ জন।


করোনায় নিজেদের ঝুঁকির কথা জানতে চাইলে ডাঃ রুবাইয়েত বলেন, সেবার মানসিকতা নিয়ে এ পেশায় এসেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছি। তবে আমরা পিছিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ আশা ভরসা হারিয়ে ফেলবে। তাই তাদের কথা চিন্তা করেই নিজেকে সামনের সারিতে রেখে যুদ্ধে নেমেছি। শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব।


করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি জানান, ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত আগামী আরও কয়েকমাস এই করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি নিয়েই আমাদের চলতে হবে। নিজেদের প্রয়োজনে সুরক্ষার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যবিধিগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।


জানা গেছে, গত ২৯ এপ্রিল দাগনভূঞায় এক নারীর শরীরে প্রথম করোনা শনাক্ত করা হয়। উপজেলায় আক্রান্তের তালিকা রয়েছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকর্তা, পৌর কাউন্সিলর, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, পুলিশ সদস্যসহ নানা বয়সী মানুষ। এরমধ্যে চিকিৎসকদের পরামর্শে ও তদারকিতে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রোখসানা সিদ্দিকী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ ৩পুলিশ সদস্যসহ ১০জন সুস্থ হয়েছেন। অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির রতন ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বিতীয় নমুনা নেগেটিভ এসেছে। তারা সুস্থ আছেন।