চলতি বছরের বাতিল হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন নিয়ে শংকায় রয়েছেন ফেনীর শিক্ষার্থীরা। তাদের আশংকা জেএসসি, এসএসসির ভিত্তিতে ফলাফল মূল্যায়ন করলে অনেক শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল পাবে না। এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এতে করে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে একই ফলাফল দেয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।

বুধবার (০৭ অক্টোবর) দুপুরে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এবারের উচ্চমাধ্যমিক তথা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনি। তিনি জানান, সার্বিক দিক বিবেচনা করে এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ করা হবে না, ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে।

শিক্ষামন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা পরীক্ষার বাতিলের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও, ফলাফল মূল্যায়ন নিয়ে আশংকার কথা জানালেন বেশির ভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস অর্পা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক হলেও ফলাফল মূল্যায়নের দিকটা নেতিবাচক এ ধরা যায়। কারণ আমরা অনেকেই জেএসসি, এসএসসির চেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। তাছাড়া জেএসসি, এসএসসির ভিত্তিতে ফলাফল মূল্যায়ন করলে অনেক শিক্ষার্থী আশানুরূপ ফল পাবে না। এ ক্ষেত্রে সবাইকে একই ফল দেওয়া উচিত।

এইচএসসি বাতিলের ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বললেন আরেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লা। তিনি বলেন, পরীক্ষা না হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল পাবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষা বাতিল করাটা অবশ্যই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

কাজী তারেক হোসেন নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অনেকে জেএসসি বা এসএসসিতে ভালো ফল না করলেও এইচএসসিতে এসে ভালো পড়াশোনা করে এবং ভালো ফলাফল করে। তাদের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন হতে পারে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এইচএসসি ফলাফল একটা বড় ভূমিকা থাকে। এতে তাদের পরিশ্রম ও স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। অনেকে ভালো ফলাফল করার জন্য প্রথমবার রেজিষ্ট্রেশন করে না। কেউ মানোন্নয়ন পরীক্ষাও দেয়।

তিনি বলেন, তাদের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিতে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। এছাড়া যারা বিভাগ পরিবর্তন করেছে তারাও যথার্থ মূল্যায়ন পাবে না। এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এতে করে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় যদি জেএসসি, এসএসসি ফলাফল যোগ করা হয় তবে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আংশকার কথা জানালেন সানজিদা ইসলাম নামে অপর এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, যাদের জেএসসি, এসএসসিতে ভালো ফলাফল ছিল না। তাঁরা এইচএসসি তে ভালো ফলাফল করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে। তাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় জেএসসি, এসএসসি পয়েন্ট যোগ না করলে ভালো হবে। এতে করে সকল শিক্ষার্থী নিজ মেধায় একটা প্রত্যাশিত জায়গায় ভর্তি হতে পারবে।

তারেক ফকির রিফাত নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এসময়ে আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক মনে করছি। যদি পরীক্ষা নেয়া হতো, তাহলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সেই সাথে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের পরিবারের ও সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এপ্রিলে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে প্রস্তুতিটা নিয়েছি, সেটাও আগের মত নেই। সেহেতু জেএসসি, এসএসসির ভিত্তিতে ফলাফল দেওয়ার পদ্ধতিটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে।

তবে পরীক্ষার বাতিল ও ফলাফল মূল্যায়ন পদ্ধতিকে সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন ফেনী সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল। তিনি বলেন, এতে করে অনেক শিক্ষার্থীর উপকার হবে। অধ্যক্ষ বলেন, এতে মেধাবী ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের ফলাফল নিয়ে চিন্তিত হওয়া লাগবে না। তবে মধ্যম মানের শিক্ষার্থীরা এতে করে কিছুটা বিপাকে পড়তে পারে। তিনি বলেন, জেএসসি ও এসএসসিতে তাদের ফলাফল হয়ত কম ছিল, কিন্তু এইচএসসিতে ভালো করার লক্ষ্যে তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল। ফলে তারা তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল হতে বঞ্চিত হতে পারে।

ফলাফল মূল্যায়নের এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে প্রফেসর বিমল কান্তি পাল বলেন, এবার প্রকৃত মেধার যাচাই হবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি পরীক্ষাতে। এসময় ফেনী কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ফেনী কলেজে বেশীরভাগ শিক্ষার্থীই এসএসসি জিপিএ-৫ প্রাপ্ত প্রাপ্ত। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা এবার অনেক বেশী পরিমাণে জিপিএ-৫ পাবে বলেন অধ্যক্ষ।

একইভাবে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ফেনী মহিপাল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারি। এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়াটা সম্ভব নয়। তাই আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সবদিক বিবেচনা করলে এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছি। যেহেতু জেএসসি, এসএসসির ফল অনুযায়ী ফলাফল মূল্যায়ন করা হবে, তাই এটিকে অটো পাস বলা যায় না।

তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। যে শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার জন্য যত ভালো প্রস্তুতি নেবে, সে ভর্তি পরীক্ষায় তত বেশি এগিয়ে থাকবে।

পরীক্ষা বাতিল না করলে অনেক শিক্ষার্থী করোনায় সংক্রমনের ঝুঁকি থাকতো বলেন ফেনী মহিপাল সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক শ্রী গোপাল চন্দ্র। তিনি বলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় জেএসসি, এসএসসি ফলাফল যোগ করা হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত করেনি। তবে সরকার শিক্ষার্থীদের সকল দিক বিবেচনা করে ফলাফল মূল্যায়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিশ্চিত করবে এই প্রত্যাশা করছি।

এ মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মেধার সুষ্ঠু যাচাই হবে না বলছেন অভিভাবকরা।

পরীক্ষা না হওয়া প্রসঙ্গে জাফরিন চৌধুরী নিলু নামের এক অভিভাবক বলেন, পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় অনেক ছেলে-মেয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। কারণ অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল পাওয়ার আশায় দিন-রাত পড়াশোনা করেছে। জেএসসি, এসএসসির ফলে ফলাফল মূল্যায়ন করলে অনেকে তাদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। এই পদ্ধতি কিছু শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক হলেও বাকীদের শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাজী আব্দুল্লা হাল বাকী নামে আরেকজন অভিভাবক বলেন, এ পদ্ধতিতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না তা ঠিক কিন্তু এখন যদি পরীক্ষা নেওয়া হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থী খারাপ করবে। কেউ কেউ এমনও আছে বিগত ছয় মাস ধরে বই এ ধরেনি। তবে জেএসসি, এসএসসির ভিত্তিতে ফলাফল মূল্যায়ন করার মাধ্যমে যুক্তি আছে, কিন্তু এ পদ্ধতিতে সুষ্ঠ মেধা যাচাই করা হবে না।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা কি পদ্ধতিতে হবে, সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিষয়টি সিদ্ধান্ত নিবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাই এ সম্পর্কে এখনো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য, গত ১ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হওয়ার আশংঙ্কা থাকার কারণে বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।