দাগনভূঞা উপজেলার শ্মশানখালী খালের উপর শত বছরেও একটি পাকা সেতু কেন হলনা, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ সিদ্দিকুর রহমান (৭৫) ও আবদুল মোমেন (৫৫) এর মনে। জন্মের পর থেকেই সাঁকোটি এভাবেই দেখে এসেছেন তারা। জনশ্রুতি রয়েছে, আনুমানিক ১৯১১-১৩ সালের দিকে স্থানীয়দের স্বেচ্ছাশ্রম ও গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলে বাঁশ দিয়ে সাঁকোটি তৈরি করা হয়েছিল। সেই থেকে অদ্যবধি উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের সাত গ্রামের ত্রিশ হাজার মানুষের সংযোগ রক্ষা করে চলেছে আনুমানিক একশত ফুট লম্বা নড়বড়ে এ বাঁশের সাঁকোটি।

উপজেলার পূর্ব চন্দ্রপুর মডেল ইউনিয়নের হাসান গনিপুর ও চাঁদপুর, মাতুভূঁঞা ইউনিয়নের মহেশপুর, হীরাপুর ও দক্ষিন লালপুর, জায়লস্কর ইউনিয়নের খুশিপুর ও দক্ষিন নেয়াজপুর গ্রামের সীমান্ত এলাকায় সাঁকোটির অবস্থান। বিকল্প না থাকায় খাল পারাপার করতে গিয়ে ব্যবসায়ী, কৃষক, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ সবাইকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর স্কুলপড়ুয়া শিশুদের প্রতিদিন সাঁকো পার হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। সাঁকো পার হতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশুরা। এমনকি পা পিছলে পানিতে পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

জামাল উদ্দিন, নরুল আমীন, আবুল হোসেন, নিজাম উদ্দিন, অজি উল্যা, সেলিম, বাবুল ও মিয়াধন নামে স্থানীয় কয়েকজন এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, সাঁকো পার হতে পড়ে গিয়ে ছুট্টু নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া খুশীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ও স্থানীয় মহেশপুর গ্রামের অটোরিক্সা চালক মোঃ সবুজের ছেলে মোহাম্মদ ইয়াসিন সাঁকো থেকে পড়ে হাত ভেঙ্গে গেছে। আর নিলয়, অপু ও পাবেলসহ আরও অনেক শিশু এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সাঁকোর উত্তর পাড়ে কোন কবরস্থান না থাকায় দক্ষিন পাড়ের কেউ মৃত্যুবরণ করলে দাফন করার জন্য উপযুক্ত কবরস্থানের খোঁজে কলাগাছের ভেলায় করে মৃতদেহ নিয়ে যেতে হয়।

এলাকাবাসীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রতি বছর বর্ষাকালে প্রবল পানির স্রোতের তোড়ে সাঁকোটি ভেসে যায়। বর্ষা শেষ হলে গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলে বাঁশ দিয়ে তা আবার নির্মাণ করা হয়। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ।

এলাকার লোকজন অনেক দিন ধরেই এ খালের ওপর একটি পাকা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু তাদের দাবি পূরণ হয়নি। তারা বলেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৯ বছরে অনেক সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এলাকাবাসীর প্রয়োজনীয়তা বা চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি যদি শুরু থেকেই প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে গুরুত্ব পেত তবে এখনো তাদের বাঁশের সাঁকোর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হত না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পূর্ব চন্দ্রপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদ রায়হান বলেন, গ্রাম হবে শহর, আর মফস্বল শহর হবে মহানগর- এ শ্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রম। এ উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে উক্ত জনদাবিটি বাদ যাবে না। আশা করি এই রকম একটি জনদাবী খুব শীঘ্রই পূরণ হবে।

খালটিতে সাঁকোর স্থলে ব্রীজ নির্মাণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করবেন বলে জানিয়েছেন দাগনভূঞার বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রবিউল হাসান। তিনি জানান, বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দাগনভূঞা উপজেলা প্রকৌশলী সৌরভ দাশ জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য লেঃ জেঃ (অবঃ) মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী’র সুপারিশে খুশিপুর পাকা সড়ক-গজারিয়া সড়ক ভায়া বাশার বাড়ি সড়কে ৯৮০.০০ মিঃ চেইনেজে ব্রীজ নিমার্ণের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ আলমগীর জানান, আনুমানিক একশত ফুট লম্বা সাঁকোটি প্রতিবছর এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রম ও গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলে বাঁশ দিয়ে মেরামত করা হয়। ওই স্থানটিতে ব্রীজ নির্মাণের করা হলে সাত গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে।

আরেক ইউপি সদস্য মোঃ জাহিদুল ইসলাম আরিফ বলেন, শ্মশানখালী সাঁকোটি সাত গ্রামের একমাত্র ভরসা। তাই এটি সংস্কারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

তবে জীবদ্দশায় খালের উপর পাকা সেতু দেখে যেতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন ওই দুই বয়োবৃদ্ধ বয়োবৃদ্ধ সিদ্দিকুর রহমান ও আবদুল মোমেন। তারা বলেন, অতীতেও অনেক আশ্বাস ও ভরসা কথা শুনেছি আমরা। কিন্তু অবস্থার কখনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের জীবন তো সাঁকো পার করেই কেটেছে, আমাদের নাতি-নাতনী ও ভবিষ্যত বংশধরদের জীবনও এভাবেই কাটবে নাকি?