ফেনীতে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়া প্রায় ২৭ কোটি টাকা মূল্যের ৭ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা পাচার মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পাঁচ বছরেও শুরু হয়নি। আদালত পর পর তিনবার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করলেও সাক্ষী হাজির হয়নি। জেলা ও দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন্নেছার আদালতে গত সোমবার (২৫ জানুয়ারি) চাঞ্চল্যকর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। ওইদিনও সাক্ষী হাজির না হওয়ায় ফের সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পিছিয়েছে আগামী ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি ধার্য করে আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের পিপি হাফেজ আহম্মদ জানান, গত বছরের ৩ নভেম্বর চাঞ্চল্যকর এ মামলায় তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাহফুজুর রহমান ও আইনজীবীসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ১০ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদালত। গত ১০ ডিসেম্বর মামলার বাদী তৎকালীন র‌্যাব-৭ ফেনী ক্যাম্পের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) নায়েক সুবেদার মনিরুল ইসলামের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন। নির্ধারিত তারিখে বাদী হাজির না হওয়ায় পরবর্তী তারিখ ৪ জানুয়ারী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। ৪ জানুয়ারীও বাদী না আসায় ২৫ জানুয়ারী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন আদালত। এদিনও সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হন নি তিনি।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোঃ আলতাফ হোসেন জানান, গত ২০১৫ ২৪ জুন মাহফুজুর রহমান ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ইয়াবা ব্যবসার সাথে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। মাহফুজের গাড়িচালক জাবেদ আলীও একই বছরের ২৬ জুন একই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এর পরদিন ২৭ জুন এএসআই মাহফুজুর রহমানের সহযোগী ইয়াবা ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে। তিনি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বাগুর গ্রামের আবদুল মোতালেবের ছেলে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফেনীর জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের বিচারক দেলোয়ার হোসেন মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন। এরপর ২০১৯ সালের ১৭ মে এএসআই মাহফুজের সহযোগী তোফাজ্জল হোসেন প্রকাশ ইয়াবা তোফাজ্জল ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে দায় স্বীকার করেন। তিনি কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌরসভার পঞ্চবটি রেলওয়ে ছোট পুকুর পাড়ের বাসিন্দা।

আদালত সূত্র জানায়, এএসআই মাহফুজুর রহমান ও তার ‘এলিয়ন’ গাড়ির চালক জাবেদ আলী ২০১৫ সালের ২১ জুন ভোরে ফেনী সদর উপজেলার লালপুল এলাকায় একটি শিশুকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‌্যাব-৭, ফেনী ক্যাম্পের সদস্যদের হাতে ধরা পড়েন। এ সময় তার গাড়ি থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবা, ইয়াবা বিক্রির নগদ ৭ লাখ টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি ক্রেডিট কার্ড উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় ১৪ জন আসামীর মধ্যে ৯জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকী ৫জন পলাতক রয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৪জন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। মাহফুজের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মিরপুর গ্রামে।

এএসআই মাহফুজ ও তার গাড়ির চালক জাবেদ আলী ছাড়াও মামলার অপর আসামীরা হচ্ছেন এডভোকেট জাকির হোসেন, মোঃ আশিকুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন, সালেহ আহম্মদ, আবদুল মোতালেব, কাশেম আলী, শাহীন, মোঃ শাহিন মিয়া, মোঃ বিল্লাল হোসেন, ফরিদুল ইসলাম, মোঃ জাফর, মোঃ রুবেল সরকার।

জবানবন্দীতে গাড়ি চালক জাবেদ ইয়াবা পাচার চক্রের আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করে। জাবেদ জানায়, দেবিদ্বারে একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করার সুবাদে এএসআই মাহফুজের সাথে তার পরিচয় হয়। সেখান থেকে মাহফুজ তাকে ১০ হাজার টাকা বেতনে নিজের গাড়িরচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এছাড়া জাবেদ মাহফুজের মালিকি জে এন্ড অল আইটেম নিউ বাজারের দেখাভাল করত ও বাজার সদাই করতো। মাহফুজ তাকে নিয়ে দেবিদ্বার, চান্দিনা, কুমিল্লা জজকোর্ট এলাকা, শ্যামপুরসহ বেশ কয়েক স্থানে ইতিপূর্বে ইয়াবা সরবরাহ করে বলেও জাবেদ জানায়।

অন্যদিকে তোফাজ্জল তার জবানবন্দিতে জানিয়েছিল, ফেনীতে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হবার আরও বছর খানেক আগে থেকে এএসআই মাহফুজের সাথে ইয়ার ব্যবসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেশ কয়েকটি চালান ইয়াবা নিয়ে বিক্রিও করেছে। প্রায় ৬০-৬৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যে চালান নিয়ে মাহফুজ ধরা পড়েছে ওই চালান থেকেও তাকে (তোফাজ্জল) ইয়াবা দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য অগ্রিম টাকাও নেয় মাহফুজ।

র‌্যাবের তথ্য মতে-গ্রেফতারের পর এএসআই মাহফুজ জানিয়েছিলেন, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফে চাকরির সুবাদে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। তার নোট বই থেকে ১৪ জনের সঙ্গে ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। কক্সবাজার থেকে আনা ৬ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবার চালানটি ঢাকায় পৌঁছে দিতে কক্সবাজার গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এসআই মো. বেলাল ও চট্টগ্রাম পুলিশের কুমিরা হাইওয়ে ইনচার্জ (আইসি) মো. আশিক তাকে অনুরোধ করেছে বলে র‌্যাবকে জানিয়েছিলেন গ্রেফতার হওয়া মাহফুজ। ঢাকায় তার কাছ থেকে ইয়াবাগুলো হাইকোর্টের মুহুরী মো. মোতালেব, এ্যাডভোকেট জাকির, এসবি কনস্টেবল শাহীন, কাশেম, গিয়াসদের বুঝে নেয়ার কথা ছিল।

পিপি হাফেজ আহাম্মদ জানান, ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিনুজ্জমান আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আদালত এতে সন্তুষ্ট না হয়ে পুনঃতদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। ২০১৬ সালের ২২ মে মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির কুমিল্লা জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন। আদালত অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে ১৪জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।

হাফেজ আহম্মদ জানান, পরপর ধার্য তিন তারিখে বাদী না সাক্ষ্য দিতে না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ পেছানো হয়েছে।