বীমা শিল্পের উন্নয়নে বহুমুখী পরিকল্পনা থাকলেও ফেনীতে একাধিক বীমা প্রতিষ্ঠানে গ্রাহক হয়রানি যেন বাঁধভাঙ্গা। সবগুলো কিস্তি জমা দিয়েও সঞ্চয় অথবা লাভ, কোনোটিই পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। এমন অভিযোগের তোপে পড়েছেন ফেনীতে ব্যবসা করছে আসা এমন একাধিক বীমা প্রতিষ্ঠান।

আজ সোমবার (১ মার্চ) বীমা দিবস। দিনটি ঘিরে দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বীমা গ্রাহক ও বীমা প্রতিনিধিদের অসহায়ত্বের চিত্র।

পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে ২শ টাকা মাসিক হারে ১০ বছরের বীমা করেন পরশুরাম উপজেলার বাউরখুমা গ্রামের বিবি ফাতেমা। ২০১৮ সালে মেয়াদপূর্ণ হলেও ফাতেমা বলেন, দুই বছর পার হলেও টাকা দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। জেলা অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা অফিস যখন টাকা দেবে তখন টাকা দেবো।

একই রকম অভিযোগ করেছেন একই এলাকার কাঞ্চু আক্তার, পেয়ারা বেগম। তারা বলছেন, প্রতিদিন বহু মানুষ ইন্সুরেন্স অফিসে গিয়ে কোন প্রতিকার পাচ্ছে না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ফেনী অফিসের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং) মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আগের মালিকপক্ষ গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারায় ২০১৯ সালে এস আলম গ্রুপ মালিকানা কিনে নেন। মালিকানা পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে ক্রমান্বয়ে গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধ করা হচ্ছিল। ২০২০ সালে বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে চেক হস্তান্তর স্থবির হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত ফেনী জেলার প্রায় ২শ গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধের বাকী রয়েছে।

নাসির উদ্দিন আরও জানান, গ্রাহকরা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা না পেয়ে আমাদের অফিসে আসছেন। অনেকে খারাপ ব্যবহারও করছেন। এক্ষেত্রে আমরা নিরুপায়। কোম্পানি টাকা না দিলে আমরা টাকা কিভাবে দেব। হেড অফিসের নির্দেশনা মতে ছোট অংকের বীমা দাবিগুলো আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি।

সানলাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ফেনী পৌরসভার সৈয়দ নগর এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, বছরে ৬ হাজার ৪২৯ টাকা করে ১২ বছর মেয়াদি বীমা করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বীমার টাকা জমা দিয়েছি। বীমার মেয়াদ পরিপূর্ণ হওয়ার পর ২০১৯ সালে কাগজপত্র জমা দিলেও এখনও টাকা পাইনি। অফিসে গেলে তারা বলে কাগজপত্র ঢাকায় পাঠিয়েছে চেক আসলে খবর দেবে।
পৌরসভার আরেক বাসিন্দা বলেন, মাসিক ২০০ টাকা করে ১০ বছর মেয়াদি বীমা করি সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি করি। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত টাকা চালিয়েছি। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর কাগজপত্র জমা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোন চেক পাইনি।
বকুল বেগম নামের আরেক গ্রাহক বলেন, বার্ষিক ৩ হাজার ৬ টাকা করে ১২ বছর মেয়াদি বীমা করেছি। ৮ কিস্তি পরিশোধ করার পর আর চালাতে পারিনি। ২০১৯ সালে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও টাকা বুঝে পাইনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে, সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি ফেনীর শাখার জুনিয়র এ.এম.ডি (উন্নয়ন) মোঃ জাফর ইমাম মজুমদার বলেন, মেয়াদপূর্ণ হওয়ার বীমা দাবি পরিশোধ না করাটা হেড অফিসের অবহেলার কারণ। এ ক্ষেত্রে আমাদের করার কিছু থাকেনা। বরং আমরা গ্রাহকদের কাছে আমরা নানা ধরনের অপমানের শিকার হই।

সানলাইফ ইসলামী ইন্সুরেন্সের ফেনীর সার্ভিসিং সেলের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (উন্নয়ন) স্বাক্ষরিত বীমা দাবি প্রাপ্তদের একটি তালিকাসহ চিঠি দৈনিক ফেনীর হাতে আসে।

১৩ নভেম্বর ২০১৯ প্রেরিত চিঠিটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর লিখিত। এতে ফেনীর ৩৫০জন গ্রাহকের এক কোটি ষাট লাখ টাকা ছাড়ের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু চিঠির পরও কোন সুরাহা হয়নি বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা।

একই অভিযোগ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর বিরুদ্ধে। মোঃ আাতিকুর রহমান নামে এক গ্রাহক জানান, ৫শ টাকা মাসিক হারে ১৫ বছরের বীমার সব কিস্তি দিয়ে টাকা ফেরত পাচ্ছেন না এক বছর। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে টাকা পেতে কাগজ জমা দিলেও এখনো টাকা পাননি।

প্রতিষ্ঠানটির ফেনী সার্ভিস সেন্টারের ইনচার্জ মিজানুর রহমান মিলন জানান, করোনা পরিস্থিতিতে গ্রাহকের টাকা প্রদানে বিলম্ব হচ্ছে। ভূমিতে লগ্নিকৃত টাকা বাজার মন্দার কারনে তুলে যাচ্ছে না। তাই গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। অনেকসময় গ্রাহকের কাগজে ভুল ভ্রান্তির কারনেও বিলম্ব হয়।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক মোঃ আব্দুস সালাম সোনার জানান, বীমা আইনে বীমার মেয়াদ পূর্ণের ৯০ কার্য দিবসের মধ্যে গ্রাহককে বীমার দাবি হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে গ্রাহক সরাসরি আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারবে। প্রমাণিত হলে গ্রাহককে জরিমানাসহ টাকা ফেরত দিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে বলা হবে।