৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ।। নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

নভেম্বর, ১৯৭১ সাল। দিকে দিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে। আকাশ নিকষ আলো অন্ধকার। ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকারে কাদার মধ্যে বুকে ক্রল করে এগোচ্ছেন ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। তার পিঠে ব্যাগ ভর্তি গ্রেনেড। লক্ষ্য মুক্তিবাহিনীর জন্য হুমকি পাকিস্তানী বাহিনীর বাংকার ধ্বংস করা। সেক্টর কমান্ডার বারণ করেছিলেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে না যেতে। কিন্তু ক্যাপ্টেন হুমায়ুন নাছোড়বান্দা। মৃত্যুর ঝুঁকি পরোয়া করেন সত্ত্বে সরাসরি চলে এসেছেন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কমান্ডো অপারেশনে।


ধীরে ধীরে শত্রুপক্ষের সীমানায় এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। ঘন্টা খানিক পড়ে শত্রুুপক্ষের বাংকার ও তার আশপাশ থেকে বিস্ফোরণের আর আত্মচিৎকারের আওয়াজ পাওয়া গেল। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের ছোঁড়া ১৩টি গ্রেনেড ধ্বংস হয়ে গেছে শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যুহ। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অসংখ্য যোদ্ধা।


রাতের অন্ধকারে কাদামাটিতে গা ঢাকা দিলেন ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। পড়ে থাকলেন নিথর, নিশ্চুপ।


কমান্ডো অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন ২নং সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুমায়ুন। তিনদিন ধরে তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ধরে নিয়েছে যে অপারেশনে গিয়ে তিনি পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার বা নিহত হয়েছেন।


চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় সময় কাটছে তার স্বজন ও সহযোদ্ধাদের। নববধূ মিসেস জাফর ইমাম ভারতের আশ্রয় শিবিরে জায়নামাযে বসে কাঁদছেন। দুহাত তুলে প্রার্থনা করছেন, এই বুঝি ফিরে এল তার প্রিয় স্বামী। তার চিন্তা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পিতা শেখ ওয়াহিদ উল্লাহ চৌধুরী। ভাই বোন সকলের চোখে জল।


এদিকে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ২নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ ও মিত্রবাহিনীর জেনারেল আরডি হীরার কপালে। অকুতোভয় এ নির্ভীক যোদ্ধার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় পায়চারি করছেন সেক্টর কমান্ডার। কিন্তু ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের কোন খবর নেই।


সবাই যখন শোকে আচ্ছন্ন হঠাৎ করে তিনদিন পরে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ফিরলেন। তার শরীর ক্ষতবিক্ষত, কাদামাখা, মুখে বিজয়ের হাসি। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুললো রনাঙ্গন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন আবারও ঝলসে উঠল সবার চোখেমুখে।


ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের পুরো নাম জাফর ইমাম, দুধর্ষ এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন একাত্তরে। হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য মূর্তিমান ত্রাস। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত পেশাদার সামরিক বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে এ অকুতোভয় বাঙালি সেনা অফিসারকে পদানত করতে, কিন্তু পারে নি।


যুদ্ধের আগের বছর। জাফর ইমাম তখন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার অফিসার হিসেবে পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে ৯ম এফ এফ পদাতিক রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। সে বছর ইউনিটের অধিনায়ক তার সম্পর্কে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এ.সি.আর) উল্লেখ করেছিলেন, `This officer has got a trend of provincialism in his mind. He can slip off the track any time if not guided properly.' অর্থাৎ এই অফিসারের মনে স্বদেশী টান আছে। ঠিকমত গাইড না করা গেলে সে যে কোন সময় ট্র্যাকের বাইরে চলে যেতে পারে।


রিপোর্ট দেখে জাফর ইমাম ঘাবড়ে গেলেন। এই রিপোর্টটি যদি পিন্ডিতে হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়, তাহলে সরাসরি চাকরী চলে যাবে। তিনি গিয়ে তার পাঠান সিও কে অনেক আকুতি মিনতি করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এ.সি.আর এর ভাষা পরিবর্তন করে স্বাক্ষর করলেন। সিও তখন জাফর ইমামকে উপদেশ দিলেন যে সামরিক বাহিনীতে চাকরীরত অবস্থায় কোন রাজনীতি অথবা কোন পক্ষে বিপক্ষে না যেতে এবং অহেতুক কোন আলোচনা-সমালোচনা না করতে।


৭০ এর শেষের দিকে জাফর ইমাম চেষ্টা তদবির করে বদলি হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে ২৪ এফ এফ রেজিমেন্টে যোগ দিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে সবুজ আগুন জ্বেলে দিলেন ৭ কোটি বাঙালির হৃদয়ে। বললেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সে আগুন জাফর ইমামের মনে তীব্রতর হয়ে উঠল।


২৫ শে মার্চ ১৯৭১, শুরু হল জান্তা ইয়াহিয়ার ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ২৬শে মার্চ আরো কয়েকজন বাঙালী অফিসারসহ তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে চট্টগ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টেনমেন্টে পাঠানো হয়। কিন্তু জাফর ইমাম আগেভাগেই নিজের পথ ঠিক করে নিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার বিমানবন্দরে অবতরণের পর পরই তিনি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে টয়লেটে ঢুকে পড়লেন। ঝটপট সামরিক ইউনিফর্ম খুলে সিভিল পোষাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এয়ারপোর্ট এর গেটের বাইরে এসে একটা বেবি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন।


সে ইউনিট কমান্ডারের কথাই সত্য হয়েছিল, তিনি ট্র্যাকের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মুক্তির সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রিয় মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষা করতে যুদ্ধ সংগঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অকুতোভয় এ দেশপ্রেমিক এ সেনা কর্মকর্তা।


কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী ট্র্যাকচ্যুত এ বাঙালি অফিসারের পিছু ছাড়ল না। তার খোঁজে একাত্তরের এপ্রিলের এক রাতে হানা দিল এলিফ্যান্ট রোডে। অল্পের জন্য সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি। পালিয়ে চলে এসে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।


জাফর ইমামের বাবা মরহুম শেখ ওয়াহিদউল্লাহ চৌধুরী ১৯৫৪ তে মুসলিম লীগ প্রার্থী হয়েছিলেন ছিলেন। তিনি ২৫ মার্চ রাতে ফেনীর মুকুটহীন সম্রাটখ্যাত খাজা আহম্মদের সাথে স্বপরিবারে ভারতে আশ্রয় নেন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। জাফর ইমামের আরেক ভাই ডাঃ হাসান ইমামও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক চাচা শেখ নুরুল্লাহ ছিলেন অনেক বছর মুন্সীরহাট ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন অনেক বছর। জাফর ইমামের নানা মোহাম্মদ সাদেক বিএ, বিএল ৩০ দশকের প্রথম দিকে তিনি একই সাথে কলকাতার প্রাদেশিক পরিষদে এমএলএ এবং দিল্লীতে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে এমএলসি ছিলেন। এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের একজন, জাফর ইমাম যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটা ছিল একেবারের ভিন্ন।


মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঢাকা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন জাফর ইমাম। পরে মেজর খালেদ মোশাররফ নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিবাহিনীর সামরিক ব্রিগেড কে ফোর্সের দুই নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ, বাঙালি সৈনিক ও মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ফোর্সের অধীন পুনর্গঠিত এ রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। যুদ্ধের পুরো ৭ মাস জুড়ে জাফর ইমাম পরিণত হন ফেনী সন্নিহিত বিলোনিয়া অঞ্চলে পাকিস্তানী হানাদারদের ত্রাসে। তিনি পরিণত হন অবস্মরনীয় যুদ্ধের কিংবদন্তী যোদ্ধায়।


ফেনীর বিলোনিয়ায় যুদ্ধে মেশিনগানের গুলি দিয়েই পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করেছিল মুক্তিসেনারা। সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বীর বিক্রম জাফর ইমাম। বহুযুদ্ধ জয় করেছেন। হারিয়েছেনও অনেক। যুদ্ধের মাত্র দুসপ্তাহ আগে বিয়ে করেছিলেন এই যোদ্ধা। তবুও নববধূ সেদিন দেশের জন্য তাকে যুদ্ধে যেতে বলেছিলেন।


ফেনী জেলার অন্তর্গত বিলোনিয়া। ১৬ মাইল লম্বা এবং ছয় মাইল প্রস্থ সরু এক ভূখন্ড। এলাকাটি অনেকটা উপদ্বীপের মতো। প্রায় গোটা এলাকাই ভারতের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এর তিন দিকেই ভারত সীমান্ত। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিলোনিয়া মুক্ত ছিল। এরপর এই এলাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখল করে। বিভিন্ন স্থানে ছিল তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিলোনিয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের অবরোধ করেন। তখন ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন জাফর ইমাম।


৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দলে দলে ফেনী শহরে প্রবেশ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। শহরবাসী ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের সশস্ত্র মহড়া দেখেছিল। ফলে সকালে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান শুনে অনেকে হকচকিত হয়ে ওঠেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ শ্লোগান প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ ফেনী শহরে মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ শনাক্ত করতে বা তাঁদের কবর চিহ্নিত করতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন স্বজনহারারা।


সামরিক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক জাফর ইমাম ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার নোয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। তার বাবার নাম শেখ ওয়াহিদুল্লাহ চৌধুরী। মা আজমেরি বেগম। স্ত্রী নূরমহল বেগম। তাঁদের কোনো সন্তান নেই। তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন।