‘প্রতি মৌসুমে ধারদেনা করে জমিতে আবাদ করি। সব সময় ফসল ঘরে তোলার আগমুহূর্তে এসে ইঁদুরের উপদ্রব ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। ইঁদুর নিধনে বিভিন্ন কৌশল ও ওষুধ প্রয়োগ করেও খুব একটা সুফল পাই না। এসব বিষয়ে কখনো আমাদের কেউ বলেওনি।’-এভাবেই ইঁদুরের উপদ্রবে স্বপ্নের ফসল নষ্ট হওয়ার কথা বললেন ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বীরচন্দ্র নগর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম।

সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি এলাকার বয়োবৃদ্ধ কৃষক সামছুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কৃষি কাজ করেই সংসার চলছে। এটিই আমার পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। বিভিন্ন সময় ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত নানা রোগবালাইয়ের আক্রমণে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কখনো কৃষি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাঠপর্যায়ে এসে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে দেখি না। সর্বশেষ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির পর এবার নতুন করে জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়েছে। বাজারের দোকানীর পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না। জানি না শেষ পর্যন্ত ফসলের কতটা ক্ষতি হয়।

শুধু আবুল কালাম বা সামছুল আলমই নন, প্রতি মৌসুমে ইঁদুরের উপদ্রবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখে পড়তে হয় ফেনীর কৃষকদের। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ইঁদুর নিধনে আয়োজন করে অভিযান ও পুরস্কার বিতরণ করেন কৃষি বিভাগ। তবে ইঁদুরের উপদ্রবে জেলায় ফসলের ক্ষতির কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। কৃষকরা বলেছেন, ইঁদুর নিধনের নামে প্রতিবছর চার দেয়ালের ভেতর বসেই একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। যেখানে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রায় সময়ই পুরস্কৃত করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিনের সঙ্গে বারবার তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে পাঠানো ইঁদুর নিধনের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর কৃষকদের পুরস্কৃত করা হয়। এতে বার্ষিক ইঁদুর নিধনের নির্দিষ্ট একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। তবে ইঁদুরের উপদ্রবে ফসলের ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ ধরনের পরিসংখ্যান করা হয় না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ইঁদুর নিধন অভিযানে জেলায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭৯২টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সোনাগাজীতে সর্বোচ্চ ৪৬ হাজার ৮২০টি ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। ইঁদুর নিধন কার্যক্রমে কৃষি বিভাগের ১০৫ জন, ৩৯ হাজার ৯৩৭ জন কৃষক, ৩৭ হাজার ২৭৫ জন শিক্ষার্থীসহ ৭৭ হাজার ৪৩৭ জন প্রশিক্ষণার্থী সম্পৃক্ত ছিল।

ফুলগাজীর আমজাদহাট এলাকার জহির নামে এক কৃষক বলেন, ধানের শীষ আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। জমির আইলে বা উঁচু কোথাও ইঁদুরের গর্ত করার মতো জায়গা না থাকলেও জমির মাঝখানে গিয়ে তারা ধান কাটছে। আমন মৌসুমে এ ক্ষতির পরিমাণ সাধারণত সবচেয়ে বেশি।

একই এলাকার কৃষক আজু মিয়া বলেন, কার্যকরভাবে ইঁদুর নিধন করা সম্ভব না হওয়াতে প্রতি বছর আশানুরূপ ফসল পাচ্ছি না। মোট উৎপাদনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ইঁদুরের পেটে চলে যাচ্ছে। ইঁদুর মেরে লেজ জমা দিলে পুরস্কৃত করা হয় জানি। তবে এখানেও নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রায় চেনা মুখগুলোই সবসময় পুরস্কার পান। এসব প্রক্রিয়ায় পুরস্কার পাওয়ার মানদ- শুধু খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের বয়োবৃদ্ধ কৃষক মো. হোসেন আহম্মদ। ছোটবেলায় নিজেদের জমিতে ইঁদুরের উৎপাত দেখে শুরু করেন ইঁদুর নিধন। বর্তমানে ৮৩ বছর বয়সে এখন সেটি তার নেশায় পরিণত হয়েছে। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরে তিনি পেয়েছেন অর্ধশতাধিক পুরস্কারও। ইউনিয়নের দশপাইয়া এলাকার বাসিন্দা হোসেন আহম্মদ এবারও ১০ হাজার ১২৬টি ইঁদুর নিধন করে পেয়েছেন আঞ্চলিক পর্যায়ে সম্মাননা।

দৈনিক ফেনীকে হোসেন আহম্মদ বলেন, ইঁদুর নিধনে পুরস্কার পেতে শুরুর সময়গুলোতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লেজ জমা দিতে হত। ৭-৮ বছর বয়স থেকে ইঁদুর নিধন করছি। পরে এরশাদের আমল থেকে ইঁদুর নিধন করে নিয়মিত পুরস্কার পাচ্ছি। তবে এখন আর লেজ জমা দেওয়া হয় না। এরপর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতি বছরই বিভিন্ন পুরস্কার পেয়ে এসেছি।

উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাসব্যাপী ফসল রক্ষায় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। এতে উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায় থেকে দেশ সেরা ইঁদুর শিকারিদের পুরস্কৃত করা হয়।