ফেনীর ব্যস্ত শহরের রাস্তায় দেখা মেলে আক্তার মিয়ার। কাঁধে কাঠের তৈরি শানদাতা চাকা, পরনে পুরনো জামা, মুখে শ্রমের ক্লান্তি আর চোখে প্রত্যাশার আলো। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ছুরি, দা, বটি শান দেওয়ার কাজ করতে সিলেটের হবিগঞ্জ থেকে এসেছেন ফেনীতে।
তিনি একা নন এই মৌসুমি কাজের খোঁজে তাঁর সঙ্গে এসেছেন আরও চারজন। কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলে ছুরি-বটি শান দেওয়ার চাহিদা বেড়ে যায়। শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে প্রয়োজন পড়ে ধারালো দা, ছুরি ও চাপাতির। এই সময়টা তাই আক্তার মিয়ার মতো মানুষের কাছে রোজগারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। বছরের অন্য সময় কাজ না থাকলেও এই ক'দিনের জন্য শহরে পা রাখলেই কিছুটা স্বস্তি মেলে সংসারের হিসেব-নিকেশে।
আক্তার মিয়া বলেন, কিছুদিন আগে ফেনীতে এসেছি। বছরের অন্যান্য সময় আমি বিভিন্ন রকম কাজ করি। কখনো ক্ষেত-খামারে, কখনো দিনমজুরি। কিন্তু কোরবানির সময় ছুরি-বটি শান দেওয়ার ভালো চাহিদা থাকে, ইনকামও হয় একটু বেশি। তাই প্রতিবছরই এই সময়ে শহরে চলে আসি।
তিনি আরও বলেন, আমার শান দেওয়ার মেশিনটা পুরনো। তবে এবার নতুন করে কাঠ লাগিয়েছি, যাতে ভালোভাবে কাজ করতে পারি।
আক্তার মিয়ার কাঁধে থাকা যন্ত্রটি ‘শানদাতা চাকা’। কাঠ, লোহা আর চাকা মিলিয়ে তৈরি এই যন্ত্র প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে হয়। অনেকটা সাইকেলের চেইনের মতো কাঠামোয় ঘর্ষণ সৃষ্টি করে ধার দেওয়া হয় ছুরি, বটি দাসহ দারালো যন্ত্রে।
প্রতিদিন সকালে বের হন, পায়ে হেঁটে শহরের অলিগলি ঘুরে কাজ খোঁজেন। কারো বাড়িতে, বাজারে, দোকানে ডাক পেলে যন্ত্র নামিয়ে বসে পড়েন। প্রতিটি শানে আয় হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। দিনে কয়েকটি কাজ হলে মোটামুটি চলে যায়।
‘এই কামাই দিয়াই কোরবানির সময় কিছু টাকা হাতে আসে। সেই টাকা লইয়া বাড়ি ফিরি, ছেলেমেয়েদের জন্য জামাকাপড় কিনি’। সারা বছর এই রকম কাম নাই’— বলছিলেন আক্তার মিয়া।
আধুনিক যন্ত্রপাতি আর বাজারে সহজলভ্য ছুরি-বটির ভিড়ে আজ এই পেশা বিলুপ্তির পথে। তবু আক্তার মিয়ার মতো মানুষরা তাদের অনেকে এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন কারণ এটিই এখনো তাদের জীবিকার শেষ ভরসা।
আক্তার মিয়ার মতোই শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে দা-বটি, ছুরি-চাপাতিতে শান দিচ্ছেন খুরশীদুর রহমান। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমি আসছি কুমিল্লা থেকে। কোরবানির ঈদের আগে কাজের সুযোগ একটু বাড়ে, তাই প্রতিবছর এই সময়টায় শহরে এসে ঘুরে ঘুরে ছুরি-বটি শান দেই। কেউ ডাকলে বাসায় যাই, বাজারে বসেও কাজ করি। এই কয়দিন ভালো রোজগার হলে ঈদের সময় বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের মুখে একটু হাসি দেখতে পারি। বাকি সময় তো নানা রকম কাজ করি কখনো রিকশা চালাই, কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী আবার কখনো কৃষি কাজ করি।
কিছুটা আক্ষেপের সুরে খুরশীদুর রহমান বলেন, এই শান দেওয়ার কাজটা পুরোনো, আগের মতো কদর নাই, কিন্তু এখনো অনেকে চায় ছুরি-বটি ভালো করে ধার দেওয়া হোক। আমরা সেইটুকুই করে দেই যতটা পারি। সবাই ঈদের আনন্দ করে, আমরাও চাই একটু ভালোভাবে দিনটা কাটুক। তাই সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করি। কষ্ট হয়, কিন্তু কাজ না করলে তো পেট চলবে না।
শহরের শান্তি কোম্পানির রোড এলাকায় একটি বাসার সামনে বসে শান দিচ্ছিলেন হরিদাস নামের আরেক শানদাতা। কাঠের তৈরি শানদাতা যন্ত্রটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছুরি ধার করছেন তিনি। ঘামেভেজা মুখে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় প্রশ্ন করতেই মৃদু হেসে বললেন, এটা মৌসুমী ব্যবসা। কোরবানির ঈদের সময় কিছুটা চাহিদা বাড়ে, তাই তখন শহরে এসে ঘুরে ঘুরে শান দিই। কিন্তু বছরের অন্য সময় এই কাজ তেমন চলে না। তখন আমাদের অন্য পেশায় ভরসা করতে হয়। কখনো রিকশা চালাই, কখনো ক্ষেত-খামারে কামলা দেই। তিনি আরও বলেন,
এই কাজটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন তো অনেকে দোকান থেকে নতুন ছুরি কিনে নেয় বা আধুনিক যন্ত্রে শান দেয়। কিন্তু এখনো অনেকে আমাদের মতো পুরোনোভাবে ধার দেওয়া লোকের ওপর ভরসা রাখে। যতদিন পারি, ততদিন এই কাজ করে যাব।
ফেনী শহরের নাজির রোডের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর আলম কোরবানির প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছুরি ও বটিতে শান দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, কোরবানির সময় তো ছুরি-বটির অনেক দরকার পড়ে। কোরবানি দিতে হলে ধার ভালো না হলে খুব সমস্যা হয়। এ সময় যখন এ ধরনের লোকজন আসে, তখন আমাদের অনেক উপকার হয়। দোকানে নিয়ে শান দিতে গেলে সময়ও লাগে, খরচও বেশি পড়ে। কিন্তু এরা ঘরে এসে কাজ করে দেয়, ঘরেই বসে সব ঠিক করিয়ে নেওয়া যায়। এটা আমাদের জন্য অনেক সুবিধাজনক।