ফেনীতে গত তিন বছরে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ২০২৫ সালে এইচএসসি, আলিম ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১২ হাজার ৪৮৭ জন শিক্ষার্থী, যা বিগত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এইচএসসিতে শিক্ষার্থী বাড়া-কমার মধ্য থাকলেও আলিমে ক্রমাগত কমছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা।

জেলা প্রশাসনের শিক্ষা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ফেনীতে এইচএসসি, আলিম ও কারিগরি পরীক্ষার্থী ছিল ১২ হাজার ৭৮৮ জন। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ১৭৯ জনে। ২০২৫ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৮৭ জনে। তবে তিন বছর আগের তুলনায় আলিম শাখায় এই কমতির হার প্রকট। ২০২৩ সালে আলিম পরীক্ষার্থী ছিল ২ হাজার ৬৩ জন। ২০২৪ সালে তা কমে হয় ১ হাজার ৯১০ জন। ২০২৫ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭১৪ জনে।

আগামী বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি, আলিম ও সমমান পরীক্ষায় ফেনী জেলার ২২টি কেন্দ্রে অংশ নিচ্ছে মোট ১২ হাজার ৪৮৭ জন পরীক্ষার্থী। এরমধ্যে এইচএসসিতে ১০ হাজার ৭০ জন, আলিমে ১ হাজার ৭১৪ জন, কারিগরিতে ৭০৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

অন্যদিকে ২০২৪ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ হাজার ১৭৯ জন। এরমধ্যে এইচএসসি ও ভোকেশনালে ছিল ১১ হাজার ২৬৯ জন, আলিমে ছিল ১ হাজার ৯১০ জন। ২০২৩ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১২ হাজার ৭৮৮ জন। এরমধ্যে এইচএসসি ও ভোকেশনালে ছিল ১০ হাজার ৭২৫ জন আলিমে ছিল ২ হাজার ৬৩ জন।

জেলা প্রশাসনের শিক্ষা শাখা সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেনীর সদর উপজেলায় এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী ৫ হাজার ৪১১ জন, আলিমে ৬০০ জন ও ভোকেশনালে ২৪৫ জন। পরশুরাম উপজেলায় এইচএসসিতে ৭৫৮ জন, আলিমে ৮৯ জন। ফুলগাজী উপজেলায় এইচএসসিতে ৭৭০ জন, আলিমে ৭৪ জন এবং ভোকেশনালে ১১০ জন । ছাগলনাইয়া উপজেলায় এইচএসসিতে ১ হাজার ২৩২ জন, আলিমে ৩৬৭ জন। সোনাগাজী উপজেলায় এইচএসসিতে ৫৭৪ জন, আলিমে ৩০৬ জন। দাগনভুঞা উপজেলায় এইচএসসিতে ১ হাজার ৩২৫ জন, আলিমে ২৭৮ জন এবং ভোকেশনালে ৩৪৮ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।

২২টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫টি এইচএসসি ও ভোকেশনালের এবং ৭টি আলিমের। যার মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় এইচএসসি- ভোকেশনালের কেন্দ্র ৫টি, আলিমের ১টি সোনাগাজীতে এইচএসসি ২টি, আলিম ১টি, ফুলগাজীতে এইচএসসি- ভোকেশনালে ৩টি, আলিম ১টি, পরশুরামে এইচএসসিতে ১টি, আলিমে ১টি, ছাগলনাইয়াতে এইচএসসিতে ১টি, আলিমে ১টি এবং দাগনভুঞাতে এইচএসসি-ভোকেশনালে ৩টি, আলিমে ২টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

জেলার শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা, কারিগরি শিক্ষায় ঝোঁক, প্রবাসী পরিবারে সন্তানদের স্থানান্তর এবং বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক কারণে এই কমতির ধারা তৈরি হয়েছে।

ফেনী সদর উপজেলার একজন শিক্ষক বলেন, অনেক শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিচ্ছে। এদের একটা বড় অংশ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অন্যদিকে আলিম পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় ধারাবাহিক পতন মাদ্রাসাশিক্ষার প্রতি কম আগ্রহ এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের ইঙ্গিত বহন করছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শফি উল্ল্যাহ বলেন, বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া ভবিষ্যতের জন্য ভালো ইঙ্গিত নয়। উচ্চ শিক্ষায় অনীহা হয়ে ফেনীতে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, ছেলেদের অল্প বয়সে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। যার কারণে এমনটা হতে পারে।

বন্যার কারণে পরীক্ষার্থী কমেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্যা অল্প সময়ের জন্য ছিল সেটির কারণে পরীক্ষার্থী কমেছে বলে আমি মনে করি না।

পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন আবহাওয়া ভালো আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষাগ্রহণের জন্য ভাল প্রস্তুতি রয়েছে। করোনার বিষয়ে সরকার থেকে নির্দেশনা আছে, মাস্ক ব্যবহার এবং নিজে সচেতন থাকা। এছাড়াও কেন্দ্রে অন্যান্য যে নিয়ম সেটি বলবৎ থাকবে।

এবার এইচএসসিতে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ১ হাজার ২শ’র অধিক শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। জেলায় পরীক্ষার্থী কমার বিষয়ে ফেনী সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার বলেন, এ জেলা প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি, এটি বড় কারণ হতে পারে। এছাড়াও একাদশ শ্রেণি থেকে অনেকে ড্রপ আউট হয়ে যায় যার ফলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।

অন্যদিকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বলছেন প্রস্তুতি ভালো, কেউ বলছেন আরেকটু সময় পেলে ভালো হত। এদিকে এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে ঢাকায় কয়েকদফা আন্দোলন করেছিল পরীক্ষার্থীরা।

ফেনী সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আরাফ মাহমুদ বলেন, “প্রস্তুতি মোটামুটি। কলেজে রিভিশন ক্লাস অনেক সাহায্য করেছে। ভয় একটু আছে, তবে নিজের ওপর ভরসা রাখছি। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে।”

ফুলগাজীর তামান্না আফরোজ নামে এক আলিম পরীক্ষার্থী বলেন, “গেল বছর আমাদের এলাকায় পানি উঠেছিল, কয়েক মাস পড়া হয়নি। পরে আবার সব গুছিয়ে নিতে হয়েছে। যদি আরও কিছু সময় পেতাম, ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারতাম”।

আব্দুল করিম নামে এক অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলে দিনরাত পড়ছে। কিন্তু গেল বছরের সরকার পতন আন্দোলন, ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি থাকায় মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে আবার সময়মতো পরীক্ষাও হচ্ছে, এটা ভালো”।

 

সোনাগাজীতে পরীক্ষার্থী অর্ধেকে নেমেছে

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সম্পর্কিত উপজেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের তুলনায় এবছর সোনাগাজীতে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০২৪ সালে সোনাগাজী উপজেলায় এইচএসসিতে ১ হাজার ১৬৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিলেও এবার অংশ নিচ্ছে ৫৭৪ জন। অন্যদিকে আলিমে ২৯৫ জন অংশ নিয়েছিল গতবছর, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৬ জনে।

উপজেলা ভিত্তিক অন্যান্য উপজেলার মধ্যে পরশুরাম উপজেলায় গতবার এইচএসসিতে অংশ নিয়েছিল ৬৮৯ জন এবার অংশ নিচ্ছে ৭৫৮ জন। বিপরীতে আলিমে গতবছর ১৩০ জন অংশ নিয়েছিল এবার অংশ নিচ্ছে ৮৯ জন। ফুলগাজী উপজেলায় গতবছর এইচএসসি ও ভোকেশনালে ৮৯৩ জন অংশ নিয়েছিল এবার অংশ নিচ্ছে ৮৮০ জন। বিপরীতে আলিমে ১০৮ জন অংশ নিলেও এবার অংশ নিচ্ছে ৭৪ জন। ২০২৪ সালে ছাগলনাইয়া উপজেলায় এইচএসসিতে ১ হাজার ১৫২ জন অংশ নিয়েছিল, এবার অংশ নিচ্ছে ১ হাজার ২৩২ জন। অন্যদিকে আলিমে ৪২৫ অংশ নিলেও এবার নিচ্ছে ৩৬৭ জন। তবে পরীক্ষার্থী বেড়েছে দাগনভূঞা উপজেলায়। দাগনভূঞা উপজেলায় গতবার এইচএসসিতে ও ভোকেশনালে ১ হাজার ৬৩৯ জন অংশ নিয়েছিল, এবার অংশ নিচ্ছে ১ হাজার ৬৭৩ জন। বিপরীতে আলিমে ১২৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিলেও এবার অংশ নিচ্ছে ২৭৮ জন। জেলার সর্বোচ্চ পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে সদর উপজেলা থেকে। তবে ২০২৪ সালের তুলনায় সদরে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। ফেনীর সদর উপজেলায় এইচএসসি ও ভোকেশনালে ২০২৪ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ৫ হাজার ৭৪৬জন, এবার অংশ নিচ্ছে ৫ হাজার ৬৫৬ জন। গতবছর আলিমে ৬৬৪ জন অংশ নিলেও এবার অংশ নিচ্ছে ৬০০ জন।


দাগনভূঞায় পরীক্ষার্থী ১৯৫১
দাগনভূঞা প্রতিনিধি
এবছর দাগনভূঞা উপজেলায় এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১ হাজার ৯৫১ জন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষাকেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছে মোট ৪টি। কেন্দ্রগুলো হলো- ইকবাল মেমোরিয়াল সরকারি কলেজ, দরবেশেরহাট পাবলিক কলেজ (পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে আতাতুর্ক সরকারি মডেল হাই স্কুল), আজিজিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও কোরশমুন্সি ফাজিল মাদ্রাসা।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইল জানান, উপজেলার মোট ৪টি পরীক্ষা কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। অংশ নিচ্ছেন ১৯৫১ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ১ হাজার ৩২৯, আলিম পরীক্ষার্থী ২৭৪ ও বিএমটি ৩৪৮ জন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স.ম. আজহারুল ইসলাম জানান, সকল পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। করোনা সম্পর্কে সচেতনতা হিসেবে পরীক্ষাকেন্দ্রে হান্ড স্যানিটাইজেশন প্রস্তুত রাখতে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। পরীক্ষা সুষ্ঠু সুন্দর নকলমুক্ত করতে ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা হয়েছে।