বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পুঁজি হচ্ছে এর বিপুল জনসংখ্যা। কিন্তু এই জনসংখ্যা যদি অদক্ষ, উদ্দেশ্যহীন, এবং শৃঙ্খলাবিহীন হয়—তবে তা সম্পদ নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের পথে এক ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম এখনো "degree-oriented" না হয়ে "skill-oriented" হয়ে উঠতে পারেনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS)-এর মতে, উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন যুবসমাজের ৩৮% বর্তমানে বেকার, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তারা একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়া, দক্ষতা ছাড়া, ভাষাজ্ঞান ও নৈতিক ভিত্তি ছাড়া শিক্ষাজীবন শেষ করছে। নেই কোনো উদ্ভাবনী চেতনা, নেই entrepreneurship বা problem-solving দক্ষতা, নেই “global competitiveness”-এর মানসিকতা। ফলে তারা হয়ে উঠছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বাড়তি বোঝা—একের পর এক তৈরি হচ্ছে "educated unemployment" নামক এক বড় জাতীয় সংকট। অথচ, “A nation’s strength lies in its skilled people, not in its numbers.”

দেশের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থপাচার এবং দুর্নীতি—সব মিলিয়ে আজকের যুবসমাজ হতাশাগ্রস্ত। অথচ চাইলে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে সুশৃঙ্খল, দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো—যেমন জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কানাডা—বিভিন্ন খাতে দক্ষ ও সুশৃঙ্খল শ্রমশক্তির উপর নির্ভরশীল। ILO ও OECD-এর তথ্য অনুযায়ী, এসব দেশে skilled workforce-এর অভাব এতটাই প্রকট যে আগামী এক দশকে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি আন্তর্জাতিক দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশ, যদি সঠিক পরিকল্পনায় তার যুবসমাজকে আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে পারে, তবে এই বৈশ্বিক সুযোগকে পুঁজি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ২৮.০১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স অর্জন করেছে। কিন্তু এর ৭২%-এর বেশি এসেছে low-skilled workers থেকে, যারা উচ্চ আয় বা মর্যাদাপূর্ণ কাজের সুযোগ পায় না।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার যুব সমাজের উপর। আজকের অদক্ষ, ভঙ্গুর, হতাশ যুবসমাজ যদি সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা পায়, তবে তারাই হয়ে উঠবে দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এখন সময়ের দাবী অদক্ষতায় বেড়ে উঠা এ বিপুল যুবক জনসংখ্যাকে দক্ষ এবং জনশক্তি হিসেবে গঠন করতে হলে প্রয়োজন, শৃঙ্খলাবদ্ধ, পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

শুধুমাত্র কারিগরি দক্ষতা অর্জন করলেই যুবসমাজ সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয় না। একজন প্রকৃত কর্মক্ষম ও দায়িত্ববান নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বগুণ এবং রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতা। এই মূল্যবোধ ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য একদিনে তৈরি হয় না; এগুলো গড়ে তুলতে হয় একটি সুনিয়ন্ত্রিত, দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

এ লক্ষ্যে, paramilitary-style disciplined training হতে পারে একটি কার্যকর ও সময়োপযোগী কৌশল—যেখানে প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি গড়ে তোলা হবে চরিত্র, নেতৃত্ব এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা।

এই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী, কাঠামোবদ্ধ ও ফলপ্রসূ একটি জাতীয় পরিকল্পনা।

 

বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে “Youth Skill & Discipline Academy” প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ৬ থেকে ১৮ মাস মেয়াদী একটি সমন্বিত বিভিন্ন কোর্স চালু থাকবে। এই কর্মসূচি শুধু একটি সাধারণ প্রশিক্ষণ নয়—এটি একটি “Transformation Program”, যার মাধ্যমে একজন দিকহীন, অদক্ষ তরুণ গড়ে উঠবে একজন দায়িত্বশীল, শৃঙ্খলাবান, কর্মক্ষম ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষম নাগরিক হিসেবে।

 

আধাসামরিক প্রশিক্ষণ কেন প্রয়োজন: প্রেক্ষাপট, উপকারিতা ও জাতীয় গুরুত্ব

Paramilitary Training বলতে বোঝায় একটি সংগঠিত, আধাসামরিক কাঠামোতে পরিচালিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি—যেখানে যুবসমাজকে শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমে প্রস্তুত করা হয়। এটি কোনো যুদ্ধঘেঁষা আয়োজন নয়; বরং এটি একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কৌশল, যা যুবশক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য গঠনমূলকভাবে প্রস্তুত করে।

 

প্রেক্ষাপট ও সময়ের প্রাসঙ্গিকতা

বাংলাদেশ বর্তমানে এক জনসংখ্যা-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। কিন্তু এই বিপুল যুবশক্তির একটি বড় অংশ আজ দিকহীনতা, মাদকাসক্তি, প্রযুক্তি নির্ভরতা, সামাজিক অবক্ষয় ও বেকারত্বের ফাঁদে আটকে আছে। দেশে অপরাধপ্রবণতা, রাজনৈতিক অপব্যবহার, সহিংসতা এবং শৃঙ্খলাহীনতা দিনদিন বাড়ছে—যার মূলে রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব ও মূল্যবোধের ঘাটতি।

এই প্রেক্ষাপটে আধাসামরিক শৃঙ্খলা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হতে পারে সময়োপযোগী একটি সমাধান—যা শুধু দক্ষতা নয়, চরিত্র গঠনেরও মাধ্যম। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষনের উপকারিতা হলো:

Discipline & Time Management: নিয়ম, সময়ানুবর্তিতা ও কর্তব্যপরায়ণতার শিক্ষা যুবদের মধ্যে গড়ে তোলে দায়িত্ববোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ।

Physical & Mental Fitness: শারীরিক কসরত ও মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাদক, অলসতা ও হতাশা থেকে যুবকদের মুক্ত রাখে এবং শরীর-মনকে প্রস্তুত করে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।

Leadership & Teamwork: একক নেতৃত্ব নয়—টিমওয়ার্ক, সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা ও নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা তৈরি হয়।

Patriotism & National Responsibility: প্রশিক্ষণ জীবনের মধ্য দিয়ে তারা শেখে দেশপ্রেম, জাতীয় দায়িত্ববোধ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিষ্ঠা—যা ভবিষ্যৎ নাগরিকত্বের ভিত্তি।

Character Building: সততা, সৌজন্যতা, সহানুভূতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ—এই চারটি গুণ গড়ে ওঠে বাস্তব প্রশিক্ষণ ও আদর্শিক অনুশীলনের মাধ্যমে।

 

রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে আধাসামরিক প্রশিক্ষণ

যদি এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ে গড়ে তোলা যায়, তবে তা হবে দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় সম্পদ গঠনের টেকসই মডেল। এটি শুধু সমাজের অস্থিরতা রোধ করবে না, বরং একটি দক্ষ, আত্মনির্ভর, সুশৃঙ্খল ও দেশপ্রেমিক জনশক্তি তৈরি করবে—যারা পারবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে। “Discipline is not about control, it's about empowerment.”

 

 

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাকরির জন্য দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত

দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে এখনও অনেক চাহিদাসম্পন্ন খাত রয়েছে, যেখানে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট। প্রয়োজনভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।

Garments & Textiles: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত হলেও এখানে দক্ষ Pattern Designer, Machine Operator, ও Quality Controller-এর সংকট রয়েছে।
Healthcare & Paramedics: নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান ও ফিজিওথেরাপিস্ট-এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
Automobile & Mechanics: আধুনিক গাড়ি প্রযুক্তি, ডিজেল ইঞ্জিন ও হাইব্রিড সিস্টেমে প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন।
Electrical & Electronics: মোবাইল সার্ভিসিং, হোম অ্যাপ্লায়েন্স মেরামত, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়্যারিং ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জন করে তরুণরা কর্মসংস্থান পেতে পারে।
ICT & Software: Graphics Design, Web Development, IT Support এবং Cybersecurity-এর মতো দ্রুতবর্ধনশীল খাতে দক্ষতা তৈরি এখন সময়ের দাবি।
Construction & Civil Engineering: দক্ষ রাজমিস্ত্রী, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান এবং সাইট ইঞ্জিনিয়ার চাহিদাসম্পন্ন।
Agro-tech & Food Processing: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে প্রশিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজন বাড়ছে।

 

জনশক্তি রপ্তানি: বেকারত্ব নিরসন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি কার্যকর পথ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো বেকারত্ব। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত তরুণ কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে, কিন্তু দেশে প্রয়োজনীয় কর্মক্ষেত্র না থাকায় এদের অনেকেই হতাশায় পড়ে যায়। অথচ, আমাদের সামনে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনাময় একটি পথ—জনশক্তি রপ্তানি।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ প্রায় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স অর্জন করেছে, যা প্রমাণ করে প্রবাসী কর্মীদের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব কর্মীর বড় একটি অংশই low-skilled workers, যাদের আয় সীমিত এবং কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।

 

কেন দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি জরুরি?

আয় বাড়ানোর সুযোগ: দক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে একই কাজের জন্য অদক্ষদের তুলনায় দ্বিগুণ বা ততোধিক আয় করতে সক্ষম।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখে।
বেকারত্ব হ্রাস: বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলে দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের চাপ অনেকটা কমে আসে।
সামাজিক উন্নয়ন: প্রবাসী পরিবারগুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়।
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি: দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও শৃঙ্খলিত কর্মী পাঠানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পায়।

 

ভাষাজ্ঞান: বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রধান চাবিকাঠি

Language Proficiency is the foundation of effective communication in global workplaces. অনেক সময় দক্ষতা থাকার পরেও ভাষা না জানার কারণে চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয়। বর্তমান বিশ্বে চাকরীর বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষা সমূহ হলো:

  • English: International communication, documentation, and customer support.
  • Arabic: মধ্যপ্রাচ্যের চাকরির জন্য অপরিহার্য।
  • Japanese, Korean: উচ্চ আয় ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগের জন্য JLPT ও TOPIK সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
  • German, French: ইউরোপীয় দেশের বিভিন্ন স্কিল ভিসার জন্য প্রাথমিক ভাষাজ্ঞান আবশ্যক।

 

প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দক্ষতাঃ দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব

বর্তমান বিশ্ব Fourth Industrial Revolution-এর যুগে প্রবেশ করেছে। যেখানে AI, Robotics, Machine Learning, Data Analytics, Digital Marketing এর মতো নতুন স্কিল চাহিদার শীর্ষে। প্রযুক্তির এই দক্ষতা গুলো না থাকলে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবো।

  • AI Tools: ChatGPT, Midjourney, Copilot ব্যবহারে দক্ষতা।
  • Coding Languages: Python, JavaScript, HTML/CSS, SQL.
  • Cloud Computing: Google Cloud, AWS, Microsoft Azure.
  • Digital Freelancing: Fiverr, Upwork, Freelancer–এর মাধ্যমে আয়।
  • Cybersecurity & Ethical Hacking: ডেটা সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

নতুন নতুন বৈদেশিক কর্মক্ষেত্র অনুসন্ধান ও প্রস্তুতি

বর্তমান বৈশ্বিক শ্রমবাজার দ্রুত পরিবর্তনশীল ও বহুমুখী। একসময় বাংলাদেশি শ্রমিকদের গন্তব্য প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য-নির্ভর থাকলেও এখন বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছে। ইউরোপ, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি উন্নত ও আধুনিক দেশগুলোতে এখন বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এই নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হলে আমাদের তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও ভাষা দক্ষতার মাধ্যমে। নিচে বর্তমান বিশ্ববাজারে চাহিদাসম্পন্ন কিছু সেক্টর তুলে ধরা হলো, যেখানে বাংলাদেশি কর্মীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে:

Green Energy (সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, ইলেকট্রিক যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ): বৈশ্বিক পরিবেশ-সচেতনতার ধারায় এই খাতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
Elderly Care & Nursing (বিশেষ করে জাপান ও জার্মানিতে): জনসংখ্যার বার্ধক্যের কারণে এই খাতে প্রশিক্ষিত নার্স ও কেয়ারগিভারের চাহিদা তীব্র।
Hospitality & Tourism (গালফ, ইউরোপ): হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল সার্ভিস—এই খাতে পেশাদার লোকবলের দরকার রয়েছে।
Maritime Jobs (ক্রুজ শিপ, অয়েল ট্যাংকার): সমুদ্রভিত্তিক চাকরিতে দক্ষ নাবিক ও টেকনিশিয়ান প্রয়োজন।
Construction & Infrastructure (UAE, কাতার, সৌদি আরব): বিশ্বকাপ ও অন্যান্য মেগা প্রজেক্টের পরও অবকাঠামোগত চাহিদা রয়েছে।
Factory Automation & Robotics (জাপান, কোরিয়া): চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে এই খাতে দক্ষ টেকনিক্যাল জনশক্তি দরকার হচ্ছে ক্রমাগত।

 

আফ্রিকা: সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের অধিকাংশই বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিয়োজিত। তবে সময়ের প্রয়োজনে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির ভৌগোলিক পরিসর সম্প্রসারণ করা জরুরি। শুধু উন্নত দেশগুলোর দিকেই নজর না রেখে আফ্রিকা মহাদেশকে সম্ভাবনার নতুন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। আফ্রিকা মহাদেশ এখন এক অবিকল্পনীয় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অঞ্চল। বিভিন্ন দেশ এখানে দ্রুত নগরায়ণ, অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে, এ অঞ্চলে দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।

নতুন বাজার: আফ্রিকার অনেক দেশ যেমন কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, ঘানা—এরা বর্তমানে ব্যবসাবান্ধব নীতিমালার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: সড়ক, রেলপথ, আবাসন, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহসহ অবকাঠামোগত খাতে বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী, ইলেকট্রিশিয়ান ও প্রকৌশলীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
কৃষি ও ফুড প্রসেসিং: উর্বর জমি ও খোলা জায়গার প্রাচুর্যের কারণে আফ্রিকাতে কৃষি, চাষাবাদ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা সফলভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন।
সেবা ও স্বাস্থ্য খাত: নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট, চিকিৎসা সহকারীর মতো পদে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

আফ্রিকায় জনশক্তি রপ্তানি ও বিনিয়োগকে ফলপ্রসূ করতে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, আফ্রিকার সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সঙ্গে শ্রম ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করতে হবে, যাতে বৈধ উপায়ে বাংলাদেশি কর্মী ও উদ্যোক্তারা সেখানে কাজ করতে পারেন। পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট ভাষা শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং দেশগুলোর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন প্রবাসীরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন।

এ ছাড়া, আফ্রিকাগামী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে। সর্বোপরি, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় কনস্যুলেট ও বাণিজ্যিক অফিস স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে আফ্রিকায় বাংলাদেশের নতুন কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।

চাহিদাভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি তৈরির রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা:

  • প্রতি জেলায় Skill Mapping করে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন।
  • সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় discipline-integrated skill academies।
  • Public-Private Partnership (PPP) ভিত্তিক শিল্প খাত সংযুক্ত টেকনিক্যাল ট্রেনিং।
  • Skill Passport System: প্রতিটি দক্ষ কর্মীর প্রোফাইল ও দক্ষতার ডিজিটাল ডেটাবেইজ।
  • Overseas Labour Market Research Cell: প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের চাহিদার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ।

উপসংহারঃ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নির্ভর করছে একটি প্রশ্নের উপর: “Are we preparing our people for the jobs of today and the careers of tomorrow?”
এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। আধাসামরিক প্রশিক্ষণ, ভাষাজ্ঞান, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং বৈদেশিক শ্রমবাজারভিত্তিক জনশক্তি গঠন—এই চার স্তম্ভে দাঁড় করাতে পারলে, বাংলাদেশের যুব সমাজ হবে একটি দুর্দান্ত, গ্লোবাল ও মর্যাদাসম্পন্ন মানবসম্পদ।

লেখকঃ প্রবন্ধকার ও শিক্ষা উদ্যোক্তা