মে, ১৯৭১ সালে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তানের করাচির মৌরীপুর বিমানঘাঁটি হতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা, ঢাকা হয়ে ভারতে যান। ভারতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আটকের চেষ্টায় তাড়া করে। এ অবস্থায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছে তিনি সাঁতরে মেঘনা নদী পার হন। সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এ ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে অত্যন্ত গোপনভাবে গোড়াপত্তন হয় ক্ষুদ্র বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর, গোপনীয়তা রার্থে যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘কিলো ফাইট’। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। সুলতান মাহমুদ তার সহ-পাইলটসহ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রথম বিমান হামলা চালান। একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে হামলা শুরুর পরই মূলত পাল্টে গিয়েছিল যুদ্ধের গতিপথ; এগিয়ে এসেছিল বিজয়ের ক্ষণ।

সুলতান মাহমুদ ১৯৪৪ সালের ১ আগস্ট ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬০ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স একাডেমি, রিসালপুরে যোগদান করেন এবং ১ জুলাই ১৯৬২ সালে জিডি(পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। সুলতান মাহমুদ পাকিস্তান বিমান বাহিনী কমান্ডার পদে কর্মরত ছিলেন। পশ্চিমাদের শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন আর পক্ষপাতমূলক আচরণে অতিষ্ঠ ছিলেন তিনি। অন্তরে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের আগুন জ্বলতে থাকলেও তখন বহিঃপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। তাই ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ও বর্বরোচিত গণহত্যা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিদের যুদ্ধ শুরুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে তাঁর অন্তরে জ্বলতে থাকা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ মুহূর্তে আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়। সুলতান মাহমুদ ১৯৭১ সালে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে। এর অবস্থান করাচিতে। স্বপ্ন ত্যাগ করে ১৪ মে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা, ঢাকা হয়ে ভারতে যান। সোনামোড়া বিএসএফ ক্যাম্প হয়ে চলে যান মুজিবনগর। ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।

সাঁতরে মেঘনা নদী পার

ভারতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আটকের চেষ্টায় তাড়া করে। এ অবস্থায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছে তিনি সাঁতরে মেঘনা নদী পার হন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছান। সুলতান মাহমুদ প্রথমে ২নং সেক্টরের (মতিনগর ও মেলাঘর) মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। পরে তিনি ১নং সেক্টরে যোগদান করেন এবং মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার হন। তিনি উদ্যম এবং অদম্য সাহসের সাথে অনেক দুঃসাহসিক অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন যেখানে তিনি স্টল ও জঙ্গল যুদ্ধে সীমিত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি তার দলের সদস্যদের সাথে রামগড় থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অনেক অপারেশন পরিচালনা করেন। 

গুলিবিদ্ধ হলেন সুলতান মাহমুদ 

১নং সেক্টরে যুদ্ধের সময় তার অপরিসীম আত্মত্যাগ প্রতিফলিত করে যে যুদ্ধে তার দেশপ্রেম, উদ্যম ও ত্যাগের চেতনা কেমন ছিল। অনেক অলিখিত ঘটনার পাশাপাশি চট্টগ্রামের মদুনাঘাটে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ধ্বংস ও চট্টগ্রাম এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অনন্য কৃতিত্ব রয়েছে তার। মদুনাঘাট বিদ্যুৎ স্টেশনটির অবস্থান চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। সাবস্টেশনের চারদিকের বাঙ্কারে ছিল তাদের অবস্থান। অক্টোবর মাসের শেষে একদিন সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। 

বদরুল আলম সেদিনের বিবরণ দেন এভাবে— ‘১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সূর্য ওঠার অনেক আগেই অন্ধকারের মধ্যে ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা ডিমাপুর থেকে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে উড্ডয়ন করলাম। সেটি আমি চালাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন সুলতান মাহমুদ (বীর উত্তম) ও সাহাবউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)। আমাদের সঙ্গে আরো দুজন ছিলেন। তারা অপারেটর। হেলিকপ্টারটি ছোট আকৃতির। নাম অ্যালুয়েট। এতে ছিল ১৪টি রকেট ও একটি মেশিনগান। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা। হেলিকপ্টারটির অন্ধকারে ওড়ার মত অবস্থায় ছিল না। তারপরও ঝুঁঁকি নিয়ে অপারেশনে রওনা হলাম। আমাদের লক্ষ্য, ফতুল্লার তেলের ডিপো। এই ডিপো থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থল, নৌ ও আকাশযানগুলোর জন্য জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। ভারতের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তানি সেনারা এখানে মজুত রেখেছিল বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অনেক চেষ্টা করেও এই ডিপোর ক্ষতিসাধন করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কারণ, এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অনেক শক্তিশালী। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে তেলের ট্যাংকারের ওপর একের পর এক বোমা নিক্ষেপ করি। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাংকারগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হয়। আগুনের লেলিহান শিখা উঠে যায় আকাশে। অপারেশন শেষে আমরা ডিমাপুর ফিরে যাই।’ প্রচন্ডভাবে সুরতি তেল শোধনাগারের বিরুদ্ধে যথাযথ নৌচলাচল এবং অস্ত্রশস্ত্র ব্যবস্থা ছাড়াই আদিম অ্যালোয়েট-৩ হেলিকপ্টার দ্বারা রাতের আক্রমণ পরিচালনা করা বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ শুরু হয় তার রাতের আক্রমণের সাফল্যের মধ্য দিয়ে। এতদিন বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ চলছিল। সেদিন পাকিস্তানের পরাজয়ের প্রথম ঘণ্টা বাজিয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। পরদিন সকাল থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ বহুমাত্রিক আক্রমণ শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি 

ডিপোতে সেই রাতের সাহসী হামলা এবং নিরাপদে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অসাধারণ কৃতিত্বের প্রমাণ বহন করে। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তার দলের সদস্যদের নিয়ে সিলেট, শায়েস্তাগঞ্জ, শমশেরনগর, মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, নরসিংদী, রায়পুরা, কুমিল্লা, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দাউদকান্দি এবং ইলিয়টগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহু অভিযান পরিচালনা করেন। মাহমুদ ২৫টি বিমান অভিযানে অংশ নেন। এরপর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়মিতভাবে তাঁরা বিভিন্ন রণাঙ্গণে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের উপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করে শত্রুর মনোবল ভেঙ্গে দেন। অত্যন্ত সীমিত শক্তি সত্ত্বেও বিপুল মনোবল নিয়ে সফল বিমান হামলার মাধ্যমে প্রমাণ করেন তাঁদের দক্ষতার উৎকৃষ্টতা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি ও শাহাবউদ্দীন আহমেদ (বীর উত্তম) একদিন হেলিকপ্টারে চেপে সিলেট শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। হেলিকপ্টারে কয়েকটি গুলি লাগে। সুলতান মাহমুদ অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে হেলিকপ্টারটি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দলবল নিয়ে প্রথম ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন সুলতান মাহমুদ। বিজয়ের পর প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স গঠন এবং তেজগাঁও বিমানবন্দর চালু করার অগ্রণীদের একজন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি ২৩ জুলাই ১৯৮১ তারিখে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৮’-এ ভূষিত হন। স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার পর চ্যানেল আইতে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সুলতান মাহমুদ বলেন— ‘আমরা কেউই মেডেল (পদক) নেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। একজন মানুষের জন্য স্বাধীনতা যে কত বড় জিনিস, যে তা হারিয়েছে তাকে ছাড়া বোঝানো যাবে না। যে সকল ভাই-বোনরা চলে গেছেন, শহীদ হয়েছেন, অনেকে অজ্ঞাত, তারাও দেশের জন্য অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাদের এখনো আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। এ খুশির ভেতরেও যদি আমরা তাদের ধীরে ধীরে খুঁজে বের করতে পারি।”

সুলতান মাহমুদ ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে ১৭ আগস্ট গুলশান আজাদ মসজিদ ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে জানাজা শেষে তাকে ঘাঁটি বাশারের শাহীন কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র: দৈনিক ফেনী প্রকাশিত ‘খেতাবপ্রাপ্ত ফেনীর ৩১ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ বই থেকে সংকলিত