ছাগলনাইয়ায় মরদেহ উদ্ধারের পর পকেটে পাওয়া একটি ব্যাংক চেকের সূত্র ধরে পরিচয় মেলে মো. আবদুল আহাদের (৪২)। পরবর্তী তার পরিচয়, কর্মজীবন, অপহরণের অভিযোগ ও ফেনীতে আসা নিয়ে উঠে নানা প্রশ্ন। মৃত্যুর তিন দিন পার হলেও এ নিয়ে কাটেনি ধোঁয়াশা।
এদিকে ফেনী থেকে আবদুল আহাদের মরদেহ নিজ জেলা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় নেওয়ার পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) হাজীপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামে পৈত্রিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। নিহতের বড় ভাই শেখ আব্দুর নুর দৈনিক ফেনীকে মুঠোফোনে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
অন্যদিকে আবদুল আহাদের পরিচয় শনাক্তে পকেটে পাওয়া চেকের সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) উত্তরা ব্যাংক ফেনী শহরের বিরিঞ্চি শাখায় গিয়ে দেখা যায়, আবদুল আহাদ এ ব্যাংকে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। হিসাবটিতে তেমন লেনদেন করেননি, চলতি বছরের ২৫ মে শেষবার তিনি টাকা উত্তোলন করেন। তবে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ হিসাবে তিনি উত্তরাধিকারী করেছেন তার বড় মেয়ে বুশরা জান্নাতকে, তখন মেয়ের বয়স ছিল ৫ বছর।পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় মেয়ে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তিনি অপহরণের পর নিখোঁজ হন।
এছাড়াও ব্যাংক হিসাবে আবদুল আহাদ নিজেকে একজন ফল বিক্রেতা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখান দ্বিতীয় শ্রেণি পাস। অথচ পরিবার ও তার অপরহণের অভিযোগ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন সিলেটের একটি বেসরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক হিসেবে।
রহস্যের জট যেন এখানেই খুলছে না , আবদুল আহাদ নিখোঁজের পর ২০১৯ সালের ২৭ মে সিলেট কোতোয়ালি থানায় করা একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করার অনুলিপি তার ভাই শেখ আব্দুর নুরের মাধ্যমে দৈনিক ফেনী প্রতিবেদকের হাতে আসে। এতে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ২ মে আবদুল আহাদ ২৬৯ শেখঘাট কোতোয়ালি, সিলেটের ঠিকানা হতে ব্যবসার কাজে বেরিয়ে আর ফেরেননি। অন্যদিক, এ ঘটনার আট মাস পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তখনকার একটি সংবাদে দেখা গেছে, আব্দুর নুর বাদী হয়ে আবদুল আহাদকে অপহরণের অভিযোগে জামালপুর জেলা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেন। ওই সংবাদে পরিবারের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল কমলগঞ্জ উপজেলার কুমড়াকাপন এলাকায় শশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ঘরে ফেরেননি আবুল আহাদ। আদালতে মামলা প্রসঙ্গে নিহতের ভাই আব্দুর নুর সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করছিল। আবদুল আহাদ নিখোঁজের পর একটি মোবাইল নম্বর থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এরপর দুইটি নম্বরে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পাঠানোর পর সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ওই নম্বরের সূত্রে ধরে খুঁজতে গিয়ে তা জামালপুর জেলায় শনাক্ত হয়। তাই সেখানে মামলা করা হয়েছিল।
ফেনীতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আবদুল আহাদ তার বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ফেনী শহরের সহদেবপুর এলাকা উল্লেখ করেছেন। তবে সহদেবপুরের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে তার ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।ফরমে দেওয়া হয়েছে তিনটি মোবাইল নম্বর। তারমধ্যে দুইটি নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য নম্বরটিতে কল দিলে সিরাজগঞ্জে বসবাসরত ব্যক্তির রেজিষ্ট্রেশনকৃত সিম বলে তিনি দাবি করেছেন।
এদিকে গণমাধ্যমে আবদুল আহাদের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর ছাগলনাইয়ার স্থানীয় এক ব্যক্তি দাবি করেন, এবারের ঈদুল আজহায় এ ব্যক্তি (আবদুল আহাদ) অন্য কসাইদের সঙ্গে তাদের কোরবানির গরু কাটতে মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে যান। তখন তাকে অপ্রকৃতস্থ মনে হয়েছিল।
আবদুল আহাদের বোন নাঈমা নাসরিন মনি ও ভাগিনা মোস্তাফিজুর রহমান শফিক এ মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দৈনিক ফেনীকে জানান, আবদুল আহাদ শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে শুল্ক ও আবগারিতে একাধিক কর্মস্থলে চাকরি করেন। তবে এ প্রসঙ্গে বিভাগটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ সংক্রান্ত সঠিক কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া থানা পুলিশের উপপরিদর্শক মো. শাহ আলম বলেন, নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে আমরা এখানে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, দেড় বছর ধরে ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকায় নিহত আবদুল আহাদ ধান কাটা, মাটি কাটাসহ দিনমজুরের কাজ করতেন। এ ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এর আগে বুধবার (২৯ অক্টোবর) সকালে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের সামনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে অজ্ঞান অবস্থায় স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে ছাগলনাইয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল বাশারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যায়। সেখানে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে তার সঙ্গে থাকা কাগজপত্র দেখার সময় উত্তরা ব্যাংক ফেনীর বিরিঞ্চি শাখার একটি চেক পায় পুলিশ। চেকে হিসাবের নাম আবদুল আহাদ উল্লেখ রয়েছে। পরে পুলিশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে হিসাব নম্বর জানালে তারা আবদুল আহাদের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
