১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক দিন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের শেষলগ্নে দেশের মানুষ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে।
প্রতি বছর সারাদেশের মতো ফেনীতেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হয় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি এলেই উচ্চারিত হয় তাদের নাম, দিবসটি চলে গেলেই আবারও এক বছরের জন্য স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান তারা। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। শুধুমাত্র দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচির বাইরে, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ ও তাদের অবদানকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য উদ্যোগের প্রয়োজন বলে মনে করছেন ফেনীর কবি ও সাহিত্যিকরা। তবে এসব উদ্যোগ কেবল দিবস কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে।
তারা জানান, ফেনীর বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে স্থায়ী জাদুঘর বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি দীর্ঘদিনের।
এ ব্যাপারে সমাজকর্মী আসাদুজ্জামান দারা বলেন, বুদ্ধিজীবীদের আমরা প্রাপ্য সম্মান দেখাতে পারিনি। আগে যারা ছিল তারাও পারেননি, আবার পরবর্তী প্রজন্ম স্মরণ করবে এমন কিছু আমরাও করতে পারছি না। এছাড়া বুদ্ধিজীবীদের ব্র্যান্ডিং করা, তাদের বীরত্বগাথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রশাসনের দায়িত্ব থাকলেও তা করেনি। এসব আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। ফেনীতে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নামে কোন নামফলক বা ম্যুরাল করা হয়নি। আবার করলেও সংরক্ষণ নেই। এছাড়া সেলিনা পারভীনের স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়টিও সরকারের উদাসীনতা বলা যায়।
জানা গেছে, দুই দফায় এখন পর্যন্ত ৩৩৪ শহিদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার, যার মধ্যে ফেনীর ১০ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। প্রথম গেজেটে অন্তর্ভূক্ত ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ফেনীর ৮ জনের নাম রয়েছে। তারা হচ্ছেন জহির রায়হান, ড. আনম ফজলুল হক মহী, ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ার, ডা. মেজর রেজাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. সিদ্দিক আহমেদ ও ড. সিরাজুল হক খান। দ্বিতীয় পর্বে ফেনীর আরও ৩ শহিদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- ড. রফিক আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ার ও ইঞ্জিনিয়ার সেকান্দর হায়াত চৌধুরী। এর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আনোয়ারের নাম দুই পর্বে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। অথচ আজও স্বীকৃতি পাননি শহিদ কবি ও সাংবাদিক ফেনীর কৃতি সন্তান সেলিনা পারভীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহিদ বুদ্ধিজীবী তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির প্রথম সভাটি হয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ওই সভায় প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের নাম অনুমোদন করা হয়। পরে অনুমোদন হওয়া ১৯১ জনের নাম প্রথম দফায় গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। এর পর গত ২০২২ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় ১৪৩ শহিদ বুদ্ধিজীবীর নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
গেজেটে নেই
শহিদ সেলিনা পারভীন
আজ শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে ১৯৭১ সালের এ দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামসরা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ। দুই দফায় এখন পর্যন্ত ৩৩৪ শহিদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার, যার মধ্যে ফেনীর ১০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। অথচ আজও স্বীকৃতির বাইরে রয়ে গেছেন শহিদ কবি ও সাংবাদিক ফেনীর কৃতি সন্তান সেলিনা পারভীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহিদ বুদ্ধিজীবী তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির প্রথম সভাটি হয় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ওই সভায় প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের নাম অনুমোদন করা হয়। পরে অনুমোদন হওয়া ১৯১ জনের নাম প্রথম দফায় গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। এর পর গত ২০২২ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় ১৪৩ শহিদ বুদ্ধিজীবীর নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
‘শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সাংবাদিকতা পদক ২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি ও অধ্যক্ষ মাহফুজা খানম বলেছিলেন, ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া একমাত্র নারী ছিলেন সেলিনা পারভীন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে কোনোভাবে স্বীকৃতির কথা নেই, তার নাম উচ্চারিত হয় কিনা আমার জানা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, তাকে আগামী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা। কিন্তু সরকারিভাবে সেটা করা হয়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সাংবাদিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় প্রেসক্লাবে শহিদ সাংবাদিকদের নামের ‘নাম ফলকে’ তাঁর নাম অঙ্কিত আছে। শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী সিরিজ ৯১’ এ তাঁর নামে ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে (১৪ই ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে)। সরকার পাঠ্য পুস্তকের পঞ্চম শ্রেণীর বইয়ে তাঁর উপর তথ্য সংযোজন করেছে। বাংলা একাডেমী শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায় ও প্রকাশিত বই “শত শহিদ বুদ্ধিজীবী গ্রন্থ” ও “শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ” এবং “স্মৃতি-৭১” (৪র্থ খন্ড) এ তাঁর উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । ড: রফিকুল ইসলাম কর্তৃক সম্পাদিত বই “বীরের এ রক্ত শ্রোত মাতার এ অশ্রুধারা” ও ফরিদা আক্তার সম্পাদিত “মহিলা মুক্তিযোদ্ধা গ্রন্থ” এ তাঁর কথা লেখা হয়েছে। রক্তের ঋণ সংগঠন প্রকাশিত গ্রন্থ “শহিদ সাংবাদিক” এবং লেখিকা-সাহিত্যিক ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা পান্না কায়সার সম্পাদিত বই “হৃদয়ে-একাত্তর” (প্রথম খন্ড) এ তাঁর উপর বিশদভাবে লেখা আছে। প্রিপ ট্রাষ্ট কর্তৃক ডঃ নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ সম্পাদিত বই “মুক্ত মঞ্চে নারী” তে তাঁর বীর গাঁথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। বৃটিশ চ্যানেল ফোর কর্তৃক “ওয়ার ক্রাইম ফাইল্স” এবং বিবিসি কর্তৃক “হাউ দ্যা ইস্ট ওয়াজ ওন” তথ্যচিত্রে তাঁর উপর তথ্য ও আলোকচিত্র সংযোজিত আছে। জাতীয় জাদুঘরে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হতে তাঁকে বিশেষ স্বীকৃতি পত্র (’৭১ এর শহিদ হিসেবে) দিয়েছে। প্রশিকার অর্থায়নে শামিম আখতার এর নির্দেশনায় শহিদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন এর জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচিত্র “শিলালিপি”, এই ছবিটি উৎসর্গও করা হয়েছে তাঁকে। ঢাকার মৌচাক মোড় হতে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটিতে এবং এর উভয় পার্শ্ব “শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক” নামে নামকরণ করা হয়।
ফেনীতে যত কর্মসূচি
১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ১৪ তারিখ সকালে ফেনী সরকারি কলেজে বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সকল সরকার বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে এবং আলোচনা সভায় অংশ নেবে।
