৩১ ডিসেম্বর ২০২৫। বিশ্বের নানা প্রান্তে নতুন বছরের উচ্ছ্বাস ও আলো ঝলমল করছে। লন্ডনের রাস্তা, নিউ ইয়র্কের স্কায়লাইন, টোকিওর শহুরে আলো-সবই উদযাপনে মেতে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আকাশ আজ ভারী, নিঃশব্দ, যেন দেশের হৃদয় শোকাহত। এই দিনটি শুধু একটি বছরের সমাপ্তি নয়- আজ এক রাজনৈতিক যুগের অবসান। বেগম খালেদা জিয়ার বিদায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক দীর্ঘ, দ্বন্দ্বময়, আপসহীন অধ্যায় নীরব সমাপ্তি । রাষ্ট্রের জীবনে কিছু দিন আসে, যেদিন সময় থমকে দাঁড়ায়, আনন্দ স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং জাতি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। এই মুহূর্তে আমরা উপলব্ধি করি- রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি নৈতিক দায়িত্ব, নেতৃত্বের দায়িত্ব এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার পরীক্ষা।

আজ ইতিহাস কোনো পক্ষপাতিত্ব করছে না। ইতিহাস শুধু দাঁড়িয়ে দেখছে- আমরা কাকে হারালাম। জাতি, রাজনৈতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন করছে- কীভাবে একজন নারী, প্রতিকূল সময়ের মধ্যে, নিজের নৈতিকতা এবং দায়িত্বের প্রতি অনড় থেকেছেন? আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই প্রশ্নের সামনে, যেটি কেবল বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসেরও কেন্দ্রবিন্দু।

“দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি ও মানুষই আমার সবকিছু।” ২০১৫ সালে লন্ডনে উচ্চারিত এই বাক্যটি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়; এটি রাষ্ট্রীয় আত্মপরিচয়, বিদায়ের ঘোষণা এবং জীবনদর্শনের চূড়ান্ত প্রকাশ। বিশ্বের বহু নেতা নির্বাসনে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নেন। শান্ত এবং সুরক্ষিত জীবন যে কোনো মানুষের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল নৈতিক প্রতিবাদ। তিনি দেখিয়েছেন, দেশ কখনো সুবিধা নয়। দেশ হলো দায়িত্ব, দায়, এবং শেষ আশ্রয়। বিদেশে থাকার সুযোগ থাকলেও তিনি দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- যা রাজনৈতিক সাহস, মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের নিদর্শন। এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। একজন নারীর নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের মূল স্তম্ভ হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তিগত ট্র‍্যাজেডির কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড কেবল ব্যক্তিগত শোক নয়; এটি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সংকটও সৃষ্টি করেছিল। সামরিক শাসনের অন্ধকারে, পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন- তিনি শুধু উত্তরাধিকারী নন, নেতৃত্বের শক্তিও তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। ট্র‍্যাজেডিই তাঁকে রাজনীতির কেন্দ্রে দাঁড় করায়। এ সময়ের রাজনৈতিক সাহস, নৈতিক দৃঢ়তা এবং দায়িত্ববোধ তাঁর নেতৃত্বের মূল ভিত্তি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-অনেক নেতা ব্যক্তিগত শোকে ভেঙে পড়েন; কিন্তু খালেদা জিয়া প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্বকে প্রথম স্থানে রেখেছেন। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক ও মানবিক নেতৃত্বের নিদর্শন।

হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রকাশ। কারাবাস, নিপীড়ন এবং রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি আপস করেননি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-তিনি ক্ষমতার চেয়ে নীতিকে বড় করে দেখেছিলেন।

১৯৮২-১৯৯১ সালের রাজনৈতিক সংকট ও গণতান্ত্রিক পুনরাবির্ভাবে তাঁর অবস্থান রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার নিদর্শন। তিনি দেখিয়েছেন, নেতৃত্ব মানে শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জন নয়; এটি নৈতিক দায়িত্ব পালন, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার নাম। তার আপসহীনতা ও নৈতিক দৃঢ়তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অমলিন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।

১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসে। এটি শুধু নির্বাচনী জয় নয়; সামরিক শাসনুপরবর্তী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পুনরুদ্ধার। শিক্ষা, অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে অগ্রগতি ঘটলেও রাজনৈতিক মেরুকরণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে এটি গুরুত্বপূর্ণ-নারীর নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। রাজনীতির এই সময়টি শুধুমাত্র দেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নারীর নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নজরকাড়া অধ্যায়। খালেদা জিয়া দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক শক্তি এবং নৈতিক দায়িত্ব একসঙ্গে চলতে পারে, যদি নেতা দেশ ও জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেন।

খালেদা জিয়ার জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক অধ্যায় লেখা হয়েছে ক্ষমতার বাইরে থাকা দিনগুলোতে। ১/১১-এর সময়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে প্রবল চাপ দেওয়া হয়েছিল। সব আয়োজন চূড়ান্ত হলেও তিনি বলেছিলেন- বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। জেল খেটেছেন, অসুস্থ হয়েছেন, তবুও দেশ ছাড়েননি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটি বিরল-একজন নেতা নিজের স্বার্থ, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা উপেক্ষা করে দেশ ও জনগণের সঙ্গে অবিচল থাকতে পারেন। এই অধ্যায়ে খালেদা জিয়ার নৈতিক ও মানবিক নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে অনন্য হয়ে ওঠে।

দীর্ঘ কারাবাস, গুরুতর অসুস্থতা এবং চিকিৎসার অনিশ্চয়তা তাঁকে মানবাধিকারের প্রতীক বানিয়েছে। রাজনীতি যখন প্রতিহিংসার ভাষা ব্যবহার করে, রাষ্ট্র কতটা মানবিক থাকতে পারে-খালেদা জিয়ার জীবন সেই প্রশ্নের নিঃশব্দ দলিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায়ের নজর কাড়ে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা রাজনীতির বাইরে থাকা উচিত কিনা তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব শুধুমাত্র ক্ষমতা বা প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানবিক সহমর্মিতা, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং দেশের প্রতি অবিচল ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।

রাজনীতির দীর্ঘ পথ চলায় বহুবার তাঁকে বিদেশে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে লন্ডন থেকেও তিনি বলেছিলেন-দেশের সংকটে দেশে থাকা প্রয়োজন। সর্বশেষ অসুস্থ শরীর নিয়েও দেশে ফিরে আসা ছিল রাষ্ট্রবোধের প্রকাশ।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর তাঁর ভিডিও বার্তায় ধ্বংস ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভালোবাসা, শান্তি এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজের আহ্বান প্রকাশ পায়। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতার প্রশ্ন নয়; এটি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালন, দেশের মানুষের সঙ্গে অবিচল থাকার প্রতিজ্ঞা।

জীবনের শেষ অধ্যায় ছিল নিঃসঙ্গ ও বেদনাবিধুর। এক ছেলের মৃত্যু, অন্য ছেলের নির্বাসন তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ভেঙে দিলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি অবিচল। তিনি চাইলে বিদেশে আরামদায়ক জীবন বেছে নিতে পারতেন।

কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন স্বদেশের ধুলোমাটি, কারাগারের নির্জনতা এবং মানুষের ভালোবাসা। ক্ষমতা নয়, দেশ এবং জনগণই সর্বোচ্চ-এটাই তাঁর রাজনীতির গভীরতম সত্য। এটি প্রতিটি ভবিষ্যৎ নেতার জন্য এক অনিবার্য পাঠ।

খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের শেখায়, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি মানুষ ও ন্যায়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক না মানুষকেন্দ্রিক, প্রতিশোধমুখর না ন্যায়নিষ্ঠ-এই প্রশ্ন আমাদের জন্য অব্যাহতি নয়। রাজনীতি ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়; রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, নৈতিক দিকনির্দেশ এবং জনগণের কল্যাণের জন্য।

বিশ্ব রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার অবস্থান নৈতিক নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যেখানে রাজনৈতিক বিতর্ক ও ক্ষমতার লোভ প্রাধান্য পায়, সেখানে তিনি দেখালেন- রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা কখনো উপেক্ষা করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার নারীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অমলিন অধ্যায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা দেখেছে-যে নেতা নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তার নেতৃত্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক, মানবিক এবং স্থায়ী।

৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ মঙ্গলবার ভোর ৬টায় বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেন। ৩১ ডিসেম্বর বুধবার বেলা দুইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় মানিক মিয়া এভিনিউতে বড় ছেলে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শায়িত হলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে, কিন্তু রেখে গেলেন এক অনিবার্য প্রশ্ন-আমরা কী ধরনের রাষ্ট্র হতে চাই। ক্ষমতাকেন্দ্রিক না মানুষকেন্দ্রিক, প্রতিশোধমুখর না ন্যায়নিষ্ঠ। ইতিহাস তাঁকে যুগ যুগ বিশ্লেষণ করবে, সমালোচনা করবেও, বিতর্কেও রাখবে- কিন্তু অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখাবে না।

তিনি শিখিয়ে গেলেন, দেশ কোনো সাময়িক আশ্রয় নয়- দেশই শেষ ঠিকানা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, নৈতিক নেতৃত্ব এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা কোনো স্থায়ী মর্যাদা পায় না।

 কলামিস্ট ও সংগঠক