ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হল অথচ একজন পাঠক আসেনি একটি সৃজনশীল বই খুঁজতে, বিক্রি হয়নি একটিও- বই বিক্রির এমন পরিস্থিতির কথা জানালেন ফিরোজ লাইব্রেরির মালিক পক্ষ ওহিদুল আলম পিটু। তিনি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি ফেনীর সাধারণ সম্পাদক।
ফিরোজ লাইব্রেরির মতো একই চিত্র দেখা গেছে ফেনী লাইব্রেরি ও হোসেনিয়া লাইব্রেরিতে। শহিদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কে হোসেনিয়া লাইব্রেরি সূত্র জানায়, গল্প-উপন্যাস কিংবা গবেষণাধর্মী বই বিক্রি হয়নি একটিও। শহরের পোস্ট অফিস সড়কে একাধিক লাইব্রেরিও ক্রেতা না পাওয়ার দাবি করেছেন।
পিটু জানান, পুস্তক বিক্রতা সংগঠনের সদস্য ২৪০ জন তন্মধ্যে ফেনী শহরে রয়েছে ৫০টি বইয়ের দোকান। এদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান গল্প, উপন্যাস, কবিতা এবং গবেষণাধর্মী বই বিক্রি করে থাকেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে ফিরোজ লাইব্রেরি ব্যতিত কোথাও তেমন সংগ্রহ নেই। এর কারণ প্রসঙ্গে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বেশ কয়েকবছর এসব বইয়ের চাহিদা কমতে শুরু করেছে, এখন তলানিতে ঠেকেছে। যেকারণে প্রকাশনীগুলো আগের মতো যোগাযোগ করে না, ব্যবসায়ীরাও বই সরবরাহের জন্য বলে না। বইয়ের দোকানগুলো এখন গাইডবই, নোটবইযের বাজার।
ক্রেতার এমন সঙ্কটের জন্য ব্যবসায়ীরা মোবাইলফোনের আধুনিকায়নকে প্রধানত দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতা পাঠককে বই থেকে দূরে সরিয়েছে।
টিপু নামে একজন বই বিক্রেতা বলেন, নতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে না। মাঝেমাঝে যারা বই খোঁজেন তারা পুরনো পাঠক। নতুন বইয়ের সংখ্যাও কমেছে।
বই বিক্রি না হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় একাধিক কবি-লেখকের সঙ্গে। কবি জাহাঙ্গীর আলম সৈয়দ এবার বের করেছেন ‘রাজহাঁসের ডানায় মৃত্যুর আর্তনাদ’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ। কবি বলেন, বইটি প্রকাশ হয়েছে সাহিত্যদেশ থেকে। মেলায় একদিন ছিলাম, স্টলের সামনে মানুষের ভিড় থাকলেও আমার বইটির কোনো কপি বিক্রি হতে দেখেনি। প্রকাশক আমাকে কিছু বই দেন, ফেনী এসে ১০ জনকে আমি বইটি ফ্রি দিয়েছি। একজন পাঠক একটি বই আমার কাছ থেকে কিনেছেন।
কবি শিরিন রহমান একুশে বইমেলায় বের করেছেন ৮০ পৃষ্ঠার কবিতার বই ‘শিশ মহল’। কালাঞ্জলি থেকে প্রকাশিত বইটির দাম ৩০০ টাকা রাখা হয়েছে। মেলা ও তার হাত থেকে ১৯ কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন এবং ১৩ জনকে তিনি বইটি ফ্রি দিয়েছেন।
ফেনীতে এবার হয়নি বইমেলা
ভাষার মাস অলিখিতভাবে বইয়ের মাস হিসেবে বাঙালির সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে। ঢাকায় মাসজুড়ে অমর একুশে বইমেলা আয়োজিত হয়। ফেনীতে একসময় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বইমেলা নিয়মিত আয়োজিত হলেও এখন অনিয়মিত। এবছর ফেনীতে হয়নি বইমেলা। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অমর একুশে বইমেলা আয়োজনে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিন্তু বই ব্যবসায়ীরা অপরাগতা জানালে তা সম্ভব হয়নি।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওহিদুল আলম বলেন, সাতদিনে যে পরিমাণ ব্যয় হয় বই বিক্রি করে তা আয় হয় না। জেনেশুনে আমরা প্রতিবছর লোকসান দেই, এবার তা সম্ভব হয়নি।
সাধারণ সম্পাদক বলেন, পূর্বে বইয়ের জন্য পাঠক লাইব্রেরিতে ভিড় করত। এখন বইয়ের পসরা সাজিয়েও আশানুরূপ ক্রেতা আসে না। কিছু পাঠক তৈরি হয়েছে মোটিভেশনাল বইয়ের। এরমধ্যে ইসলামিক মোটিভেশনাল বইয়ের কিছু পাঠক তৈরি হয়েছে। তারা লাইব্রেরিতে এসে বই সংগ্রহ করে। কিছু পাঠক রয়েছে রাজনৈতিক দলের। রাজনৈতিক নেতা ও দলের তথ্যভিত্তিক কিছু বই কিনতে ক্রেতা আসেন।
ফেনী হতে বই প্রকাশের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে বহুবছর আগে। প্রতিকূল এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকা ভাটিয়াল প্রকাশন এবার একটি বই প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে ভাটিয়াল প্রকাশক আলমগীর মাসুদ বলেন, বই থেকে অনেকটা দূরে রয়েছে পাঠক। বইয়ের দোকানগুলোতে বছরের অন্যান্য সময়গুলোয় বই বেচা-বিক্রি তেমন একটা হয় না। ফলে প্রকাশক ও লেখকরা আশা করেন বইমেলার ওপর। কিন্তু অমর একুশের বইমেলা ২০২৫-এ বইয়ের বেচা-বিক্রি সেরকম হয়নি বলে কয়েকজন প্রকাশক ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।
বই প্রসঙ্গে আরও প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাগজ, কালি, প্লেট, কাভার পেপার, লেমিনেটিং, ফয়েল, বাঁধাইসহ বই ছাপানোর প্রায় সকল কিছুর দাম অনেক বেড়েছে ফলে বইয়ের উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে।