চলতি বছরের ১৭ মে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে বের হন ফুলগাজী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মিতা রানী। সেদিন বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া ব্রিজ এলাকায় মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে তখন নানা আলোচনার সৃষ্টি হলেও সর্বশেষ প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া তথ্যে দুর্ঘটনার তথ্য নিশ্চিত হন পুলিশ প্রশাসন।

গত ২৭ আগস্ট দাগনভূঞায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল হোসেন দুর্জয়। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ডান পায়ে তিনটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৭ লাখ টাকার বেশি চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়েছে। তবুও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি। এখন শয্যাশায়ী থেকে কখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব তাও জানিনা।

শুধু মিতা কিংবা দুর্জয়ই নন, এমন আরও অনেক ঘটনার চিত্র দেখা যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর ২৬ কিলোমিটার, ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কসহ জেলার অন্যান্য সড়কগুলোতে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসেই এসব সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ৬৬ জন। বেপরোয়া গতি, অদক্ষ চালক ও ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু

প্রয়োগের অভাবে দীর্ঘ হচ্ছে এ মৃত্যুর মিছিল।

ফাজিলপুর ও মহিপাল হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফাজিলপুর অংশে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৩১টি দুর্ঘটনার তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। এতে ১৫ জন নিহত ও ৪১ জন আহত হয়েছেন। সড়কে বিভিন্ন অপরাধে ৯টি মামলা দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে চারটি মামলায় ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র ও দুইটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা ও অ্যাম্বুলেন্স। এছাড়া মহিপাল হাইওয়ে থানার আওতাধীন এলাকায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছেন ৯ জন। এসব ঘটনায় ৩৯টি মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২১টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, অন্য মামলাগুলো তদন্তাধীন রয়েছে।

একইসময়ে শহরের সদর হাসপাতাল মোড়, ফেনী-সোনাগাজী সড়কের কলঘর ও ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক এলাকায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, উপজেলাগুলোর অনেক দুর্ঘটনার তথ্য পরিসংখ্যানে আসে না। এজন্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রকৃত প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

এদিকে এসব দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে বেশিরভাগই পথচারী, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী ও মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

এর আগে জেলা পুলিশ বিভাগের একটি তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হন। চলতি বছরের একই সময়ে এসে যা আরও ঊর্ধমুখী লক্ষ্য করা গেছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান দারা দৈনিক ফেনীকে বলেন, দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতি। চালকের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা, শিক্ষার অভাব, ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, সড়কে যানচলাচলে ব্যবহৃত চিহ্নগুলো না চেনা দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা, থ্রি হুইলার, যাত্রীদের অসচেতনতা ও চালকদের বেপরোয়া গতির মানসিকতায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিষয়গুলো তদারকিতে হাইওয়ে পুলিশ বা থানা পুলিশের খুব বেশি তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়না। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের যথাযথ নজরদারি থাকলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিসচার সাধারণ সম্পাদক বলেন, এ সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো এখানে অনেক বাঁক রয়েছে। পাশাপাশি বাজার ও জনবহুল এলাকাও দায়ী। এছাড়া সড়কে চলাচলকারী গাড়িগুলোর বেশিরভাগই ফিটনেসবিহীন এবং চালকরাও অদক্ষ। এতে মালিকপক্ষের দায় অনেক বেশি।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি জাতীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ফেনী জেলা কমিটির উদ্যোগে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রচারপত্র বিতরণ ও চালকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা হয়েছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।

দুর্ঘটনা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে যা বলছেন হাইওয়ে পুলিশ

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আশঙ্কাজনকভাবে দুর্ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ জানিয়েছে ফেনীর সচেতন মহল।

এ ব্যাপারে কথা হয় ফাজিলপুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, চালকরা সচেতন হলে ও ট্রাফিক আইন মেনে চললে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। বেপরোয়া গতির কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে না পারায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ সড়কে কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। অতিরিক্ত গতি, ওভারলোড ও ঘুম চোখে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি।

একই প্রসঙ্গে মহিপাল হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ছোট যানচলাচলের জন্য সার্ভিস লেন না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। মহাসড়কে এ ধরনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ এখন অনেক কষ্টকর হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সড়কে যাত্রীবাহী বাস দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এতে ঘুম নিয়ে গাড়ি চলানো ও চালকদের অসচেতনতা বেশি দায়ী। দুর্ঘটনারোধে মামলা দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আমাদের কেউ চাঁদাবাজি বা এ ধরনের কিছুতে জড়িত নেই। বরং আমরা এমন কিছু দেখে ঘটনাস্থলে গেলে জানতে পারি, বিভিন্ন পক্ষের নামে ইজারার মাধ্যমে টাকা তুলছে।

এ ব্যাপারে হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম দৈনিক ফেনীকে বলেন, এখন মানুষের সঙ্গে সড়কে অনেক যানবাহন বেড়েছে। তার সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী মহাসড়কে অবৈধ যানচলাচল প্রতিরোধের বিষয়টি কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও এখন পুরোদমে কাজ চলছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ ও থ্রি হুইলার নিয়ন্ত্রণেও নিয়মিত মামলা হচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধে স্পিডগান ও অটোমেশন ক্যামেরার মাধ্যমে গাড়ির গতি পরীক্ষা করা হয়। অতিরিক্ত গতিতে চলাচলকারী গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সড়কে হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্য এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী বা যেকেউই আমাকে অবগত করলে ব্যবস্থা নেব, এতে কোন ছাড় নেই। পুলিশের চাকরি করবে, আবার চাঁদাবাজিও করবে-এমনটি হতে দেওয়া হবে না।