বিদায় ২০২৪ সাল। স্বাগত ২০২৫। সময়ের পাতা থেকে আরো একটি বছর মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। কালের পরিক্রমায় ২০২৪ সমাপ্ত। একটি নতুন বছরকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের থাকে অনেক প্রত্যাশা। যদিও গত বছরটি ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত ঘটনাবহুল একটি বছর। ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গত জুলাইয়ে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলো তার প্রভাব পড়েছে সমাজে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন যাত্রায়। তাই ২০২৫ সালকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা যেন অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব কতটা মিলবে সেটা হয়তো অনাগত দিনগুলোই বলে দেবে।

তবে সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালটি ছিল যেন এক অস্থিরতা আর নৈরাজ্যের বছর। সরকার পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষাঙ্গনে ধারাবাহিক অস্থিরতা আর নৈরাজ্য, রপ্তানি বাণিজ্যে ধস-সবকিছু মিলে সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো সুখবর বয়ে আনতে পারেনি। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের অবস্থা দিশাহারা। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও মানুষের আয় তো আর বাড়েনি। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সংকুলান যেন হচ্ছে না। মধ্যবিত্ত থেকে হতদরিদ্র সবারই যেন অভিন্ন অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে বাজারে গিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ মানুষের মনে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হয়েছিল যে বাজার পরিস্থিতি এখন বোধহয় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যত কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি। বরং বছরের শেষপ্রান্তে এসে দেখা যাচ্ছে, দিন দিন বাজার পরিস্থিতি আরো নাজুক হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি টেকসহ সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থা চালু করতে পারলে আসছে নতুন বছরে এসব নাজুক পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষের হয়তো মুক্তি মিলবে বলে আশা করা যায়।

দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ছিল এ বছরের অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালীন পুলিশ বাহিনী একেবারেই যেন লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রশাসনিক পর্যায়ে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাটের চরম সুযোগ লাভ করে। কিছুদিন ধরে সে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও, দেশের নানা স্থানে চুরি, ডাকাতির উপদ্রবের পাশাপাশি ছিনতাইকারীদের যেন রাজত্ব চলছে। দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির অপচেষ্টা মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে, সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দেখা দিচ্ছে জানমালের নিরাপত্তার ভয়, উৎকণ্ঠা।

আসছে নতুন বছর সাধারণ মানুষ এই নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি চায়। আশা করা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে প্রশাসন কঠোরভাবে নজর দেবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সড়ক, মহাসড়কগুলো অবরোধ করার এক চরম বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা গেছে। এভাবে সড়ক-মহাসড়কগুলো অবরোধ করে রাখায় নগরবাসীকে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার যে তীব্র দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তা ছিল বর্ণনাতীত। আন্দোলনের নাম করে সড়ক অবরোধ, ঘেরাও অবিলম্বে বন্ধ হোক- সেটাই সবার প্রত্যাশা। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এসব কর্মকা- বন্ধে প্রশাসনও এগিয়ে আসুক। নতুন বছরে সড়কে ফিরে আসুক শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে জনজীবনেও শান্তি ফিরে আসবে।

আবার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষাঙ্গনে বছরজুড়েই ছিল এক প্রকারের অস্থিরতা আর নৈরাজ্য। গণঅভ্যুত্থানের সময় দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উপযুক্ত সময় হতে পারে এই নতুন বছর। নতুবা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা চলতেই থাকবে। যা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে বিঘিœত করবে। নতুন বছরটি হোক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার বছর। কেননা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে জাতিকে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তরুণ শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং জনগণ তাদের আস্থায় নিয়েছিল। কিন্তু জাতিকে যদি সত্যিকার অর্থেই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তারা উপহার দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে মেধা ও মননে তাদের যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে হবে। অর্বাচীনের মতো আচরণ পরিহার করতে হবে। তা কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই সম্ভব। সেজন্য শিক্ষাঙ্গনে দরকার শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।

পাশাপাশি এ বছর বিগত সরকার বিদায় নেয়ার পর থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার মাধ্যমে শিক্ষকদের যে ব্যাপক লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হতে হয়েছে তা একটি কলঙ্কিত ইতিহাস হয়ে থাকবে। শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের সম্মানহানি করলে জাতিকে বিবেকের মুখোমুখি হতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে এসব ঘটনার যেন আগামীতে আর কখনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, নৈরাজ্য বন্ধে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সুসম্পর্কের মেলবন্ধন তৈরি হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের নাম করে যে কোনো দাবি-দাওয়ার মুখে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের যে অশুভ তৎপরতা সারা বছর ধরে লক্ষ্য করা গেছে তাও দূর হওয়া আবশ্যক। নতুবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যের যে কালো ছায়া পড়তে শুরু করেছে তা থেকে অচিরেই মুক্তি আসবে না। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার এই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান, বেতনভাতা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণ হোক নতুন বছরের আমাদের অন্যতম সংকল্প।

এ বছর ১ জানুয়ারি আর বই উৎসব হচ্ছে না- যা সরকারের তরফ থেকে আগেই জানানো হয়েছে। নতুন বছর এলেই খুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন পাঠ্যবই নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে নতুন বছরে আশা করা যায়। প্রতিবছরই পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, পরিবর্তন নিয়ে এ দেশে সব ধুন্ধুমার কা- ঘটে। পাঠ্যপুস্তকের ঘন ঘন অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়, যা ছাত্রছাত্রীদের সুকোমল মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আসছে নতুন বছরে পাঠ্যপুস্তকে আরো বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে রচিত গল্প, কবিতা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। এ বছর আন্দোলন চলাকালীন প্রায় ২ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। এখনো পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেগ পেতে হচ্ছে। সুতরাং কালবিলম্ব না করে যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছাবে- এটাই নতুন বছরে সবার প্রত্যাশা।

যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিকাশের উল্লেখযোগ্য শর্ত। গঠনমূলক সমালোচনা মেনে নেয়ার মনোভাব সবার থাকা চাই। চলতি বছর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বারবার আঘাত এসেছে, যা নজিরবিহীন। দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্র অফিসে দুর্বৃত্তদের হামলা হয়েছে, এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার আর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে আরো সজাগ হতে হবে।

২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সাধারণ মানুষ চেয়েছিল জনজীবনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আইনশৃঙ্খলা থেকে বাজার পরিস্থিতি সবকিছুতে চেয়েছে স্বস্তি। কিন্তু কোনো পরিবর্তন তো আর রাতারাতি ঘটে না। তবে সারা বছর যেন নৈরাজ্যই সর্বাধিক চোখে পড়েছে। নতুন সমাজকাঠামো ঘিরে পরিবর্তন প্রত্যাশীদের ভেতর প্রত্যাশা থাকাটা স্বাভাবিক।

নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছ থেকে মানুষ আশা করে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। কিন্তু স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার তেমন কোনো প্রতিফলন দেখতে না পেয়ে মানুষ নতুন বছরের অনাগত দিনগুলো নিয়ে কিছুটা হলেও আশাহত। প্রশাসনের ধারাবাহিক ব্যর্থতা যদি এভাবে চলতেই থাকে, তবে সামনের দিনগুলোতে বাড়তে পারে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। তাই সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার। নতুন বছরের নতুন দিনের সূর্যোদয়ে সব অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যাক। জাতীয় জীবনে ফিরে আসুক শান্তি আর সমৃদ্ধি। হিসাবের খাতায় অপ্রাপ্তির থেকে প্রাপ্তির পাল্লাটা ভারী হয়ে উঠবে- এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মাহজাবিন আলমগীর
শিক্ষক