ছয় মাস পার হতে চললেও গত আগস্ট মাসে ফেনীর ভয়াবহ বন্যার ধকল এখনো কাটেনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় পুনর্বাসন অপ্রতুল। বন্যার ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে মানুষ। জেলা প্রশাসন হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সর্বমোট ৮ হাজার ৬৫৯টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৭১৮টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৯৪১টি ঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি বেসরকারিভাবে ঘর মেরামতে সহযোগিতা করা সম্ভব হলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সরকারিভাবে প্রথম পর্যায়ে ১১০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ ও পূর্নবাসন শাখা হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে ৪০০ বান্ডিল ঢেউটিন ও গৃহমঞ্জুরি ব্যয় বাবদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা ২০০টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্নবাসনে বিশেষ আবাসন নির্মাণ শীর্ষক পাইলট প্রকল্পের আওতায় ফেনীতে ১১০টি ঘর নির্মাণ করছে সেনাবাহিনী। যার মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৫টি, ফুলগাজী ২০টি, ছাগলনাইয়া ২০টি, পরশুরাম ২০টি, সোনাগাজী ৫টি ও দাগনভূঞাতে ১০টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। দু’টি ডিজাইনে ঘরপ্রতি ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে ব্যয় হচ্ছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো: মাহবুব আলম জানান, সরকারি এবং বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত সহযোগিতা সমন্বয় করে পুনর্বাসনের কাজ চলমান রয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা গেলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রথম পর্যায়ে পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যা অল্প কিছুদিনের মধ্যে শেষ। বাকিদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে আছে ধাপে ধাপে বরাদ্দ পেলে বাস্তবায়ন হবে।

তিনি বলেন, এখনও বিভিন্ন এনজিও তালিকা চাচ্ছে কাজ চলমান রয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট ১৯০টি ঘর করে দেবে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো প্রায় মেরামত শেষ। এরপরেও বাকি থাকলে আবেদনের প্রেক্ষিতে করে দেওয়া হবে।

প্রাপ্ত তথ্য দেখা যায়, সরকারি উদ্যোগের বাইরে বেসরকারিভাবে আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে প্রতি পরিবারে ৪ বান্ডিল করে ১৫৭ পরিবারকে ঢেউটিন এবং নগদ সাড়ে ৬ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। নৌবাহিনী কর্তৃক ৮৫টি নতুন ঘর নির্মান এবং ফুলগাজীতে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ফুলগাজীতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর উদ্যোগে ১০০ টি ঘর মেরামত করা হয়েছে।
এছাড়াও ইউএনডিপি কর্তৃক প্রথম পর্যায়ে ৩ হাজার পরিবারকে ঘর মেরামত বাবদ ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে এবং ২য় পর্যায়ে ২ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নারী প্রধান ১১শ টি পরিবারকে ১১ হাজার টাকা করে দেবে ইউএনডিপি।

ডব্লিউএফফি কর্তৃক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬ উপজেলার ১৭ হাজার ৯৯৪ টি পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করে ১০ কোটি ৭৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও মানুষের আয়বৃদ্ধি কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা সহায়তা বাবদ ১ হাজার ৩২১টি পরিবারের প্রত্যককে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন কর্তৃক সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৭টি পরিবারকে কমপ্লিট আধাপাকা ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৮ হাজার ৯৭০ পরিবারকে নগদ ৩০ কোটি ১৯ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে এবং ৬০ জন রিকশাচালককে ৬০টি অটোরিকশা প্রদান করা হয়েছে।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক ৫ হাজার ৫০০ পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়াও ফুলগাজীতে লেট্রিন নির্মাণ ও টিউবওয়েল বিশুদ্ধকরণের কাজ করা রয়েছে। মাস্তুল ফাউন্ডেশন কর্তৃক ৯৯২ পরিবারকে হাউজহোল্ড বিল্ডিং মেটেরিয়্যালস বাবদ ১১ লাখ ৫০০ টাকা, রিক কর্তৃক পরশুরাম উপজেলায় ৮৭০ পরিবারকে বিভিন্ন অনুপাতে নগদ টাকা প্রদান, সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবারের প্রত্যেককে নগদ ৩০ হাজার টাকা এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবারের প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে৷ এছাড়াও ১৯০ পরিবারের মাঝে বিতরণ চলমান এবং বিদ্যালয় ও টিউবওয়েল সংস্কার করা হয়েছে।

ইপসা কর্তৃক ছাগলনাইয়া উপজেলায় সসম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১৪১ টি পরিবারের প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯৮ পরিবারকে ১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। নিয়ার কর্তৃক সদর উপজেলার ২৫ পরিবারকে নগদ ২৪ হাজার টাকা করে প্রদান এবং এসসিআই কর্তৃক সদর উপজেলার ১০ পরিবারকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে।

ব্র্যাক কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ২১৪টি পরিবারকে ঘর মেরামতের জন্য ৩০ হাজার টাকা এবং ১৬২ পরিবারকে জীবিকা পুনরুদ্ধারের জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করে। এছাড়াও ১ হাজার ৪৭৬ পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। ৫০ টি ইনস্টিটিউশন মেরামতের জন্য ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও গাল্ফ কো অপারেটিভ সোসাইটি, এডজওয়ার সেন্ট্রাল মস্ক লন্ডন, লাইফএইড, ঢাকা আহসানিয়া মিশন,অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, কেয়ার বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়ান হিউমিনিটেরিয়ান পার্টনারশিপ ও বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগণের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলায় ঘর মেরামত, নলকূপ স্থাপনসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ১২০ কি.মি রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। ৬৯টি সড়কে ব্রীজ-কালভার্ট সংস্কারের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে৷ অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পরশুরামে ৪৭টি, ফুলগাজীতে ৪৮ ও সোনাগাজীতে ৪টি স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ করছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পাইলটিং প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের শুধুমাত্র সরকারিভাবে দেয়া হচ্ছে এমন না। অনেক এনজিও সংস্থা, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ঘর নির্মাণে কাজ করছে। সরকারি পুনর্বাসন কাজ অনেক লম্বা প্রক্রিয়া কারন রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ সবগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়। এরমধ্যে ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যে সকল এনজিও কাজ করছে তাদের সাথে সমন্বয় করে ঘরগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। এ ১১০টি কাজ শেষ হলে বেসরকারিভাবে নির্মিত সবগুলো যাচাই করে যেগুলো বাকি থাকবে সেগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।