ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ফেনীর সায়েদুল ইসলাম সাকিব দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিলেও অবশেষে তার একটি চোখ হনষ্ট হয়ে গেছে। আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর তার বাম চোখ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গত শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে তার চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়।
সাকিব গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিতে মহিপালে উড়াল সেতুর নিচে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং সেখানে তিনি গুলিতে আহত হন। এরপরদিন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ছাগলনাইয়ায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে তার বাম চোখে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় সাকিবকে। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। টানা কয়েক দফা অস্ত্রোপচার ও দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়ার পরও সাকিবের বাম চোখটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
আহত সাকিব ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তার বাবা অসুস্থ থাকার কারণে বর্তমানে কর্মক্ষম নন, আর মা মনোয়ারা বেগম গৃহিণী।
সাকিব তার আহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে দৈনিক ফেনীকে বলেন, ১৬ জুলাই আন্দোলনে আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। পরদিন, ১৭ জুলাই ফেনীর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। এরপর থেকে ফেনীতে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোতেই বন্ধু এবং সহপাঠীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপাল অংশে আন্দোলনের সময় আমার হাতে গুলি লাগে, তবে সেদিন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাই। এরপরদিন, সরকার পতনের আগ মুহূর্তে আমরা ছাগলনাইয়ায় আবার আন্দোলনে অংশ নিই। আন্দোলন চলাকালীন সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে সরকার পতনের খবর জানতে পারি। তখন চারদিকে গোলাগুলির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় একটি গুলি এসে সরাসরি আমার চোখে লাগে।
সাকিবের মা মনোয়ারা বেগম জানান, গত ১৭ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় সাকিব গুরুতর আহত হয়েছিলেন, তবে সে বিষয়টি পরিবারের কাউকে জানাননি। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তারা পুরো ঘটনার ব্যাপারে জানতে পারেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, "দীর্ঘ আট মাসের লড়াই শেষে আমার ছেলে তার বাম চোখ হারিয়েছে। আমাদের পরিবারে বড় ছেলে উপার্জন করেন, স্বামী অসুস্থ থাকায় কর্মক্ষম নন। ছেলের চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করলেও আনুষঙ্গিক খরচ চালানো আমাদের জন্য খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেলেও আর কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাননি। কান্নাজড়িত কন্ঠে সাকিবের মা আরও বলেন, "আমার ছেলেকে যেন পুনর্বাসন করা হয়, যাতে সে আমাদের পরিবারের বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সাকিবের বাবা নুরুল আলম বলেন, আন্দোলনে আমার ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। প্রথমদিকে কোথাও ভালো চিকিৎসা পাচ্ছিলাম না। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে পারিনি। পরবর্তীতে সরকারি সহায়তায় তাকে ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন তার বাম চোখ অপসারণ করতে হয়েছে। সে আর কোনোদিন বাম চোখে দেখতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ছেলেকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। আজ সে নিজেই জীবনের ভার বইতে পারবে কি না, সে প্রশ্নে আমরা ভেঙে পড়েছি।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেনী জেলার সাবেক সমন্বয়ক ওমর ফারুক বলেন, আহত সাকিব যে চোখটি হারিয়েছেন, তার জন্য আমরা গভীরভাবে ব্যথিত। মূলত সাকিবদের যথাসময়ে চিকিৎসা দিতে না পারায় এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ক্রমান্বয়ে ঘটছে। অথচ সরকার এবং জুলাই ফাউন্ডেশন একরকম নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমাদের অনেক আহত সহযোদ্ধা এখনো হাসপাতালে, যাদের মধ্যে কারো কারো বিদেশে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। একইভাবে জুলাই ফাউন্ডেশনও নিরব ভূমিকা পালন করছে, যা জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, আহত সাকিবসহ হাসপাতালের বেডে থাকা সব আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায় বর্তমান সরকার এবং জুলাই ফাউন্ডেশনকে নিতে হবে।