২০২৪-২৫ অর্থবছরে ফেনীতে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে জেলার ২০০ জন খাদ্য ব্যবসায়ীকে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি হয়েছে বিভিন্ন সেমিনার, করা হয়েছে মনিটরিং কার্যক্রম। তবে, বাস্তবে এর সুফল তেমন একটা মিলছে না। প্রশিক্ষণের পরও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী আগের মতোই অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য বিক্রি করে চলেছেন। জেলায় শুধুমাত্র ১০টি হোটেল রেস্তোরাঁকে এখন পর্যন্ত গ্রেডিংয়ের আওতায় আনতে পেরেছে জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গৃহিণীদের অংশগ্রহণে ৮টি উঠান বৈঠক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০টি সেমিনার এবং জেলা পর্যায়ে ২টি সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও মোবাইল ল্যাবের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা, প্রতি মাসে অন্তত দুটি নমুনা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো, ২০০টি খাদ্যস্থাপনা মনিটরিং, ১৬ হাজার ১৫৫টি অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও মামলা দায়ের করা হয়েছে।

চলতি অর্থ বছরে একাধিক ধাপে খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এতে হোটেল-রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, বেকারি ও বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহণ ছিল। প্রশিক্ষণে খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন এবং পরিবেশজনিত স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, অনেক দোকানেই এখনো সঠিকভাবে খাদ্য সংরক্ষণ হচ্ছে না। অনেক ব্যবসায়ী ব্যবহার করছেন নিম্নমানের উপকরণ, এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর দিচ্ছেন না।

জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা সামছুল আরেফিন বলেন, আমরা নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছি। কিন্তু শুধু প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়, ব্যবসায়ীদের সচেতন হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, মানহীন উপকরণ এবং আইন না মানার প্রবণতা বড় সমস্যা। খাবার মেঝে থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখার নিয়ম, মাস্ক ও এপ্রোন পরা এসব কেউ মানছে না।

তিনি বলেন, সর্বোপরি জনগণকে সচেতন হতে হবে। ভোক্তা ভালো খাবার গ্রহণ করলে এবং খারাপটি পরিহার করলে পরিবর্তন আসবে। মানুষ কম দামে খাবার নিতে চায়, তাই ভালো মানের পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়। ভোক্তারা ভালো মানের খাবার বেছে নিলে খারাপটি জায়গা হারাবে।

তবে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, তারা নিয়ম মেনে চলতে চায়, তবে সবসময় পারে না। বাস্তবায়নের কাজই এখন আমাদের করণীয়।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠনগুলোর অভিযোগ, অনেক প্রশিক্ষণই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণের অভাবে কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু প্রশিক্ষণ নয়, নিয়মিত মনিটরিং, আইন প্রয়োগ এবং ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

একজন হোটেল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রশিক্ষণে অনেক কিছু বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে তা মেনে চলা কঠিন। খরচ বেড়ে যায়, লাভ কমে। মালিকরা সচেতন হলেও কর্মচারীরা অনেক কিছুই জানে না, তাই সমস্যা হয়।

আরেকজন রেস্তোরাঁ মালিক বলেন, অনেক ব্যবসায়ী আইন মানতে চায় না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণ দেয়, কিন্তু কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ বেশি প্রয়োজন। কারণ তারাই খাবার তৈরি ও পরিবেশন করে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক কর্মশালায় ফেনী জেলা হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার কবির শাহজাদা বলেন, অল্প শিক্ষিত কর্মচারীরা নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তা অধিকারের বিষয়ে জানে না। কেবল মালিক নয়, কর্মচারীদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনলে সেবার মান আরও উন্নত হবে। জরিমানা দিয়ে সচেতনতা বাড়ানো যায় না।

কলেজ শিক্ষার্থী সায়েম উল্লাহ বলেন, আমরা জানি না আমাদের আশেপাশের খাবারগুলো নিরাপদ কিনা। বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও সচেতনতার অভাবে তা কার্যকর হয় না। এখনও খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে অনেক ব্যবসায়ী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে খাদ্যর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাজ নয়, এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রত্যেক দপ্তরকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নানা উদ্যোগ নিতে হবে।



একজনের কাঁধে পুরো জেলা, নিরাপদ খাদ্য অফিসে পদ সৃষ্টির অপেক্ষা

খাদ্যদ্রব্যের মাননিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জনগণকে সচেতন করে খাদ্যবিষয়ক আইন প্রয়োগের মাধ্যমে গুণগত মান রক্ষার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয়। তবে জেলাপর্যায়ে ফেনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২০ সালের শেষের দিকে দপ্তরটির কার্যক্রম শুরু হয়। জেলায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের পাঁচ বছর পার হলেও কেবলমাত্র একজন কর্মকর্তা দিয়ে চলছে এ দপ্তর। নেই পরিবহন সুবিধা, এতে সঠিক সময়ে অভিযোগের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। বর্তমানে ১৬ লাখ মানুষের এ জেলার ছয় উপজেলায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, খাদ্যর নমুনা সংগ্রহ করাসহ নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম একজনের কাঁধে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফেনীতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের জন্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন সামছুল আরেফিন। তার সহযোগী হিসেবে শুধুমাত্র একজন নমুনা সংগ্রহকারী ও একজন অফিস সহায়ক কর্মরত। এ দপ্তরে এখন পর্যন্ত তিনটি পদ ব্যতীত আর কোন পদ সৃষ্টি হয়নি।

ফেনীর সাধারণ ভোক্তারা বলেন, এতো বড় দায়িত্ব একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে সম্পন্ন করা খুবই কঠিন। ফলে সঠিক সময়ে পরিদর্শন, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্যদ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণে পদ সৃষ্টি করে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।


এ ব্যাপারে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা সামছুল আরেফিন বলেন, জনবল কম হলেও বছরব্যাপী নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। সীমিত সম্পদ ও জনবল দিয়ে যতটুকু সম্ভব খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছি। তবে পুরো জেলায় খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে আরও জনবল প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও খাদ্য নমুনা পরীক্ষার জন্য ভাল মানের ল্যাবরেটরি প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম দৈনিক ফেনীকে বলেন, পদ সৃষ্টির বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। বিদ্যমান যে কাঠামো রয়েছে সেটি দিয়ে জেলায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাজ বাস্তবায়নের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে কাজগুলো করার চেষ্টা করছে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কাজ করলে হবে না। কৃষি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর এখানে কাজের সুযোগ রয়েছে।