কলেজ শিক্ষার্থী মিতা রানী নাথের মৃত্যুর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও কাটেনি ধোঁয়াশা। সময়ের সঙ্গে উঠে আসছে নানা তথ্য। গত শনিবার (১৭ মে) রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় মিতাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান অজয় সাহা নামে এক যুবক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিনি নিজেকে মিতার স্বামী বলে পরিচয় দেন। একই সঙ্গে মিতার শারীরিক অবস্থার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেও অজয় কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
গতকাল বুধবার (২১ মে) রাতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রায়হান উদ্দিন চৌধুরী দৈনিক ফেনীকে এমন তথ্য জানিয়েছেন। তিনি সেদিন রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন।
সেদিন মিতার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ডা. রায়হান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে আনার সময় রোগী (মিতা) অচেতন অবস্থায় ছিলেন। তার শ্বাসকষ্ট, শরীরজুড়ে আঘাত ও ব্যথা ছিল। তাৎক্ষণিক বাহ্যিকভাবে কিছু আঘাত চিহ্নিত করতে পারলেও অভ্যন্তরীণ আঘাত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। তবে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক ছিল।
রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় হাসপাতালে ভর্তির কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার শরীরের বাহ্যিক আঘাতগুলো এতোটাও গুরুতর ছিল না যে তা থেকে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে। দেখে এমনটি মনে হয়নি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তখন রোগীর বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্যও উপস্থিত ছিলেন না। এজন্য জরুরি চিকিৎসার বিষয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পরে তার সঙ্গে থাকা লোকদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা হয়। এখানে নিয়ে আসার আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ডা. রায়হান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোগীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, একটি বাসের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগার পর আবার আরেকটি বাসের সঙ্গে আলাদাভাবে দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানান।
এদিকে হাসপাতালে ভর্তির পর মিতার শারীরিক অবস্থা জানতে কথা হয় সেদিন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের নতুন ভবনে চতুর্থ তলায় কর্তব্যরত একজনের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, রোগীর (মিতার) শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে, তা কোনো সড়ক দুর্ঘটনার নয়। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণত যেমন ক্ষত হয়, এটি তেমন ছিল না। এসব চিহ্ন দেখে মনে হয়েছে রোগী শারীরিকভাবে আঘাতের শিকার হয়েছেন। রোগীর সঙ্গে তখন আমার কথা হয়েছিল। তখন তার বুক ও পা জ্বালাপোড়া করছে বলে জানিয়েছিল।
মহিপাল হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন উর রশিদ বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। অভিযুক্ত যুবককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, শহরের সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা তপন লাল নাথের মেয়ে ফুলগাজী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মিতা রানী গত শনিবার বিকেলে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। পরবর্তীতে সেদিন রাত ৯টা ১২ মিনিটে অজয় সাহা নামের এক যুবক মিতার বড় বোন অপর্ণাকে মুঠোফোনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার আহত হওয়ার কথা জানান। একই সঙ্গে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসার কথাও বলেন অজয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে মিতার মৃত্যুর পরপরই সটকে পড়েন অজয়।
হাসপাতালে নেই সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ
কলেজ শিক্ষার্থী মিতার মৃত্যুর ঘটনায় এখনো কাটেনি সংশয় ও রহস্যের জট। মৃত্যুর কারণ নিয়ে উঠে আসছে নানা তথ্য। নিশ্চিত হওয়া যায়নি দুর্ঘটনাস্থলও। এ ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা সেদিন মিতার সঙ্গী কথিত বন্ধু অজয় সাহা। অন্যদিকে একটি পিকআপ ভ্যানে মিতাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেও এ নিয়ে জানা যায়নি সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য। হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরা সচল না থাকায় সংরক্ষণে নেই এসব তখনকার দৃশ্য।
জানা গেছে, গত বছরের আগস্টে বন্যার পর থেকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো বিকল হয়ে আছে। দীর্ঘ সময় পার হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ এ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা সচল না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সেবাগ্রহীতারা।
রাশেদুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, জেলার ১৬ লাখ মানুষের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র এ হাসপাতাল। প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা এখানে। কিন্তু এত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে সিসি ক্যামেরা না থাকা অবশ্যই উদ্বেগজনক। সংশ্লিষ্টরা এ দায় এড়াতে পারেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. কামরুজ্জামান দৈনিক ফেনীকে বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা সংক্রান্ত বিষয়টি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আওতাধীন। এটি আমাদের বিষয় নয়। ইতোপূর্বে তাদের এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওই বিভাগের দায়িত্বরতরা। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো মেরামত না করছে, ততক্ষণ আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সিসি ক্যামেরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্যামেরা সচল থাকা অবস্থায় চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দ্রুত শনাক্ত ও প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হতো। বর্তমানে ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
