গেল বছর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল ফেনী। ৮ মাস অতিক্রম হলেও বন্যার ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাধারণ মানুষ। বৃষ্টি হলেই জনপদে এখন বন্যার আতংকÑএ বুঝি বন্যা এল! এরমধ্যে ঘনঘন বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, নদীভাঙনে মানুষ বারবার বিপাকে পড়েছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ঝুঁকি নয়, পূর্ব প্রস্তুতিতে জোর দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

গতকাল বুধবার (২১ মে) জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্যবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে গৃহীত হয়েছে বাস্তবভিত্তিক একাধিক সিদ্ধান্ত। সভায় গেলবারের বন্যার মতো যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সবাইকে একযোগে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান জেলা প্রশাসক।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। এজন্য উপজেলা, পৌরসভা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত দ্রুত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর তালিকা করে দক্ষ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলায় ৬ উপজেলার জন্য ৬টি স্পিডবোট, ৩০টি ফাইবার বোট, উদ্ধারকাজের জন্য রেসকিউ বোট, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, টর্চলাইট, গামবুট, হ্যান্ডমাইক, রেইনকোটের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই এসব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। জেলাপ্রশাসনের কাছে তাঁবু, তেরপাল, কম্বল, শুকনো খাবার, জেরিক্যানসহ জরুরি ত্রাণসামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে।
দুর্যোগকালীন জরুরি যোগাযোগ নিশ্চিত করতে মোবাইলফোন নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ সংযোগ সচল রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে জেলা প্রশাসক বলেন, প্রয়োজনে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখা যায়।পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগকে আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়াও এলজিইডির সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত চলাচলের ব্যবস্থা করা, জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা, জেলায় কি পরিমাণ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকবে সেগুলো সময়মত জানানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন তিনি। এ বিষয়ে একটি মোবাইল অ্যাপ বা পোর্টাল নির্মাণ করার নির্দেশনা দেন তিনি যেখানে ত্রাণ, উদ্ধারকাজসহ যেকোন বিষয়ে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করা হবে।
সামান্য বৃষ্টিতেই ফেনীর শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক ডুবে যাওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, এটি নিচু এলাকা। এরমধ্যে পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো ভরাট করে রাখা হয়েছে প্লাস্টিক দিয়ে ময়লা আবর্জনা ফেলে। বর্তমানে পৌরসভা ও ৪-৫টি দপ্তর একযোগে ড্রেন সংস্কারে কাজ করছে। আগামীতে এ সমস্যা থাকবে না। পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি। এছাড়াও গ্রামেগঞ্জে নির্বিচারে মাটি কাটার বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের কথাও তুলে ধরেন তিনি। মাটিকাটা বন্ধে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকবেই। এজন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। ফেনীতে অতীতে এমন বন্যা হয়নি তাই অভিজ্ঞতা ছিল না। এখানে উঁচু জায়গা নেই, যেখানে প্রাণিসম্পদ কিংবা অন্যদের রক্ষা করা যাবে। এগুলা নিয়ে আলোচনা চলছে, ব্যবস্থা করা হবে। গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগাম জোর প্রস্তুতি নেওয়া হবে। মুহুরী কহুয়া সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধনির্মাণের বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

তিনি আরও বলেন, ত্রাণ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। একাধিকবার যেন কেউ সহায়তা না পায় এবং কেউ বঞ্চিত না হয় সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সেনাবাহিনীর ফেনী ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আরেফিন শাকিল বলেন, দুর্যোগের আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা জরুরি। দূরবর্তী এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে বাহন, স্পিডবোট ও জনবল আগেভাগে প্রস্তুত রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ সচল রাখতে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে।
সিপিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সভায় জানান, ফেনীতে বর্তমানে সিপিবির ২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এর মধ্যে ২৪০ জনকে সম্প্রতি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৬ উপজেলায় রেড ক্রিসেন্টের ১৭৫ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানানো হয়।
সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিম বলেন, জরুরি ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসামগ্রী উপজেলা পর্যায়ে মজুত আছে। যেকোনো প্রয়োজনে মেডিকেল টিমও প্রস্তুত রাখা হবে।
সভায় অন্যান্য সদস্যরা বলেন, প্রস্তুতি না থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে। এসময় তারা দুর্যোগ মোকাবেলায় সবরকমের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকী, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলালসহ, বিদুৎ বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, বিভিন্ন উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান ও জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।