ফেনীতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমন প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে ১৯২৬ সালের স্মৃতিকথা তুলে ধরেন পঞ্চাশের দশকে গণতন্ত্রীপার্টির সভাপতি মাহমুদ নুরুল হুদা। নজরুলের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ফেনীর এই কৃতি সন্তানের উদ্ধৃত অংশটুকু হুবহু তুলে ধরা হলÑ
“আমি যখন ফেনী স্কুলে পড়তাম তখন কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার চাচা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো। বিশেষত আবদুল আজিজের নাতি-নাতনি বাহার ও নাহারের সঙ্গে এ সময়ে নজরুলের বেশ হৃদ্যতা জমে ওঠে। চট্টগ্রামের তামাকুকুণ্ডিতে আবদুল আজিজের বাড়িতে নজরুল ইসলাম একাধিকবার গেছেন। আমার বড়ো ভাই শামসুদ্দীন মাহমুদ তখন এ বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতেন। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগর থেকে নাহারকে লেখা একটি চিঠিতে নজরুল ইসলাম আমার বড়ো ভাইকে স্নেহাশিস জানিয়েছেন, তাতে অনুমান করি তামাকুমুণ্ডীর বাসায় আমার বড়ো ভাই নজরুলকে আপ্যায়নের ব্যাপারে বেশ সহায়তা করেছিলেন। এ সময়ে আমি তামাকুমুণ্ডীতে একাধিক বার বেড়াতে গেলেও নজরুলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ হয়নি।

চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদী দলের যুবকরা তামাকুমুণ্ডীর এই বাড়িতে তখন ভিড় করতেন। বাহার এবং আমার বড়ো ভাই শামসুদ্দিনের কাছ থেকে আমি সেসব কথা শুনতাম। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, জলু সেন প্রমুখের অবাধ যাতায়াত ছিলো এ বাড়িতে। নজরুলের এ বাড়িতে অবস্থান সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের এ উন্নয়ন ঘটিয়েছিলো। আমি নিজে এর সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি প্রধানত বয়সের কারণে।

নজরুকে আমি প্রথম দেখি ১৯২৬ সালে ফেনীতে জুন-জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে। একদিন দুপুরের ট্রেনে ফেনীর সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণে নজরুল ইসলাম ফেনী এসে পৌছান। সঙ্গে ছিলেন হবীবুল্লাহ বাহার, কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী, এবং কয়েকজন তরুণ শিক্ষক। ফেনী ইসলামিয়া হাইস্কুলের প্রাঙ্গণে কবির সংবর্ধনা ও জলসার আয়োজন করা হয়েছিলো। বর্তমানে এ জায়গাটি মিজান ময়দান নামে পরিচিত। কবি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এসেছিলেন সকালে আর অনুষ্ঠান শেষে রাত্রেই চট্টগ্রামে ফিরে যান। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

নজরুল ইসলাম তখন গেরুয়া রঙের খদ্দরের দোপাল্লা টুপি, হালকা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি এবং খদ্দরের সাদা ধুতি পরেছিলেন। সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। তা সত্ত্বেও উপস্থিত জনতা ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝখানে নজরুলের গানের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই নজরুল তাঁর গামছায় বাঁধা হারমোনিয়ম গলায় বেঁধে গাইতে শুরু করেন-“দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার,” “শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল” প্রভৃতি গান। শ্রোতাদের অনুরোধে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে নজরুলকে আরো অনেক গান গাইতে হয়েছিলো। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে ভিজে ভিজে অনুষ্ঠান করে এবং এক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে থাকলে নজরুল ইসলাম তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে রাস্তার পাশে খানসাহেব বজলুল হকের বৈঠকখানায় উঠে আসেন। লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক ওবায়দুল হক এই বজলুল হকের পুত্র।

বজলুল হক সাহেবের বৈঠকখানায় বসে আমার ভাগ্নে হবীবুল্লাহ বাহার কবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে বলেছিলেন, “ইনি আমার নানার ছোট ভাই সাবরেজিস্ট্রার সাহাবুদ্দীন মোহাম্মদ মাহমুদের ছেলে “ধনু মামা।” প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে নজরুলের সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়ে কী কী বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিলো, তা আজ আর মনে নেই।”
-লেখকের আত্মজীবনী ‘আমার জীবনস্মৃতি’ হতে উদ্ধৃত