গ্যাজেটভুক্ত হতে এবং অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে ফেনী সদরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে সাক্ষাৎকার দেন ২৫২ জন। সাক্ষাৎকার শেষে কমিটির সদস্যরা ৫২জনকে মঞ্জুরের সুপারিশ করেন, ১৮৬ জনকে নামঞ্জুর এবং ১৪ জনের ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত মতামতসহ প্রতিবেদন জামুকা’য় (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) প্রেরণ করেন।

যাচাই-বাছাইয়ের পর জামুকা’র নিশ্চয়নের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর একজনের বেসামরিক গ্যাজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যিনি সদরের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে নামঞ্জুর হয়েছিলেন।

এরপর ২০২০ সালের ১৮ মে জেলায় ৪৯ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্যাজেট প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে সদরের ৩৬ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশকৃত ৫২ জন হতে ২২ জন এবং নামঞ্জুরকৃতদের মধ্য থেকে ১৪ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেসামরিক গ্যাজেট প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, সদরে ৩৭ জনের মধ্যে মোট ১৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০১৭ সালের যাচাই-বাছাই কমিটিতে নামঞ্জুর হয়েছিলেন। জামুকার ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত তথ্য, সংক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহকৃত প্রমাণাদি, ২০১৭ সালে ফেনী সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদন হতে উক্ত তথ্যগুলো নিশ্চিত করা হয়েছে।

সাত সদস্যের সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে নামঞ্জুর হওয়া স্বত্বেও জামুকায় আপিল করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্যাজেটভুক্তের বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

২০১৭ সালে গঠিত সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ বলেন, কমিটিতে সদস্য সচিব ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সাক্ষাৎকারে সকলে একমত হয়ে মঞ্জুর, নামঞ্জুর প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। যেখানে মতভেদ হয়েছে সেখানে দ্বিধাবিভক্ত মতামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই কমিটি জামুকার পক্ষ হয়ে প্রাথমিক কাজ করেছে। এখানে নামঞ্জুর কেউ কেউ মামলাও করেছিলেন। কীভাবে তারা মঞ্জুর হলেন তা জামুকা ভাল জানে।

কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক বলেন, সর্বসম্মতক্রমে যাচাই-বাছাই কমিটিতে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল। পরে জামুকা কোন্ তথ্যের ভিত্তিতে নামঞ্জুরকে মঞ্জুর করেছেন তা বোধগম্য নয়, দ্বিতীয়দফায় যারা জামুকার আপিল বোর্ডে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারা সেখানে নতুন কী কাগজপত্র উপস্থাপন করেছেন তা কেবল তারাই ভাল বলতে পারবেন।

যাচাই-বাছাই কমিটিতে নামঞ্জুর হলেও এত অধিকসংখ্যক (৩৭ জনের মধ্যে ১৫ জন) কোন্ পন্থায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্যাজেটভুক্ত হল, এমন প্রশ্ন করা হয় জামুকার চট্টগ্রাম বিভাগীয় এ সম্পর্কিত কর্মকর্তাকে। মুঠোফোনে তিনি প্রতিবেদককে মতামত প্রদানে অপারগতা জানান। একজন সেবাগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদককে তিনি জানান, তখন কীভাবে নামঞ্জুরকে মঞ্জুর করেছে তা জানা নেই। আপিলের নিয়ম হল যে কেউ আপিল করে নিজের অধিকার আদায় করতে পারেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকার ছাড়াও প্রয়োজন হলে মাঠপর্যায়ে তথ্য যাচাইয়ে প্রতিনিধিদল গিয়ে থাকেন।

ফেনী সদর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটিতে জামুকা প্রতিনিধি সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল আহাম্মদ। তিনি দৈনিক ফেনীকে বলেন, আপিলকারী কারও দ্বিতীয়দফায় যাচাইয়ে আমাদের ভূমিকা ছিল না। জামুকা ফের মাঠপর্যায়ে তথ্য যাচাই করতে এসেছে এমন দেখিনি এবং শুনিনি। কমিটিতে জামুকা প্রতিনিধি হিসেবে অন্ততঃ আমার জানা নেই।

জামুকা সূত্রে জানা গেছে, যাচাই-বাছাই কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে এখানেও তিনজন সাক্ষী হাজির করতে হত।

যাচাই-বাছাই কমিটিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে নামঞ্জুর হয়ে পরে জামুকায় আপিল করে গ্যাজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন এমন একাধিকের সাথে কথা বলে দৈনিক ফেনী। তাঁদের একজন ফেনী শহরে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সকল কাগজপত্র ঠিক থাকলেও উপজেলা কমিটি আমাকে নামঞ্জুর করেছিল। জামুকায় আপিল করে গ্যাজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি।

জামুকায় সাক্ষাৎকারে কতজনের কমিটি ছিল জানতে চাইলে তিনি মনে নেই বলে জানান। মুক্তিযুদ্ধকালীন কী কী তথ্য আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকার বাসায় আছে। সেসব কাগজপত্র কখন দেখানো যাবে জানতে চাইলে তিনি জানান, তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে সতীর্থদের কয়েকজনের নাম জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের কেউ এখন আর বেঁচে নেই।

একই প্রসঙ্গে যাচাই-বাছাই কমিটিতে নামঞ্জুর হয়ে পরে গ্যাজেটভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আদালতের মাধ্যমে অধিকার আদায় করেছি। যাচাই-বাছাই কমিটির কারও কারও ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। সাতজনের কমিটির একজন সদস্য নিজেই কমিটিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যিনি বিচারক তিনিই পরীক্ষার্থী”।

যাচাই-বাছাই কমিটিতে অন্য সদস্যরা ছিলেন তৎকালীন জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর আবদুল হান্নান, উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আফছার এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল প্রতিনিধি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হালিম।

ফেনীতে অবস্থান করছেন এমন একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, যাচাই-বাছাইয়ে নামঞ্জুর হয়ে ফের মঞ্জুরের প্রসঙ্গটি ধুম্রজাল তৈরি করেছে। এছাড়া সেসময় প্রার্থীদের পক্ষে টাকার বিনিময়ে সাক্ষ্যপ্রদানের অভিযোগ তীব্রতর ছিল। একইসাথে ছয় উপজেলায় যাচাই-বাছাই কমিটির এক বা একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধেও অনৈতিক আচরণের অভিযোগ উঠেছিল।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে গ্যাজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ৩ হাজার ২৮১জন। এরমধ্যে ছাগলনাইয়ায় ৮শ, দাগনভূঞায় ৩৫৩, সদরে ৮১৫, ফুলগাজীতে ৩৫২, পরশুরামে ৩৩০ এবং সোনাগাজীতে ৬২১ জন।