ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সম্ভাব্য ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘু চাপ কেন্দ্র করে ফেনীতে সম্ভাব্য বন্যার শঙ্কা আবার জেগেছে। গেল বছরের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি এখনও জেলায় দৃশ্যমান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার প্রশাসন থেকে স্বেচ্ছাসেবক, সেনাবাহিনী থেকে স্থানীয় জনগণ সবাইকে নিয়ে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে ফেনী জেলা প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার (২৮ মে) জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আতঙ্ক নয়, প্রস্তুতিই আমাদের বড় অস্ত্র।
জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, স্বেচ্ছাসেবক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা অংশ নেন।
সভায় সম্ভাব্য ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যার আশঙ্কার আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুর্বল বাঁধ চিহ্নিত করে ব্যবস্থাগ্রহণ, শুকনো খাবারের ব্যবস্থা রাখা, মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ, সরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নথি, জেনারেটর, ব্যাটারি, রেডিওসহ যন্ত্রপাতি অক্ষত রাখার ব্যবস্থাগ্রহণ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা এবং উদ্ধার কাজের জন্য সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, রোভার স্কাউটস, রেড ক্রিসেন্ট, সিপিবিসহ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানান, ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি যদি হয়, তাহলে জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকি বাড়বে। ফুলগাজী ও পরশুরামে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সম্ভাব্য ভাঙন প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে মেরামত ও প্রতিরোধমূলক কাজ চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রস্তুতিও তদারকির কথা জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, উজানের পানি মুহুরী নদী হয়ে ফেনী এলাকায় প্রবেশ করলে সংকট তৈরি করতে পারে। তাই বাঁধের দুর্বল স্থানগুলোতে জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখতে হবে। গতবার ফুলগাজীতে পানির আঘাত লেগেছিল। সে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আরও সচেতন থাকতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সহযোগিতা করবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয়ভাবে রেড ক্রিসেন্ট, সিপিবি ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুত রাখা হবে। যাতে একযোগে দুর্যোগ মোকাবেলা সম্ভব হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জরুরি তহবিল থেকে তাৎক্ষণিক সহায়তা এনে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি উপজেলাতে জরুরি তহবিল গঠন করে রাখা হচ্ছে, যাতে যেকোনো মুহূর্তে তা কাজে লাগানো যায়।
আতঙ্কিত না হওয়ার আহবান জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ফেনীর মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে জানে। আমাদের কাজ হবে মানুষকে আতঙ্কিত না হতে বলা এবং সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিশ্চিত করা। সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়ন করতে পারলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সজীব কর জানান, গত বছরের বন্যায় ফুলগাজী ও পরশুরামে প্রায় ১১০টি স্থানে বাঁধ ভেঙেছিল। মেরামত করা হলেও যেসব স্থানে এখনও ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জিও ব্যাগ প্রস্তুত রয়েছে, প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড আশঙ্কা করছে, ২০২৪ সালের মতো যদি পরিস্থিতি হয়, তাহলে কিছু কিছু জায়গায় বাঁধ ভাঙতে পারে।
বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, গতবার পানির সঙ্গে ভেসে যাওয়া বল্লামুখা বাঁধটি এবার সংস্কার করা হয়েছে। তারাই স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজটি করেছে। এবারে সেই বাঁধ দিয়ে পানি ঢোকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হতে পারে।
সেনাবাহিনীর ফেনী ক্যাম্পের মেজর আরেফিন শাকিল জানান, গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আমরা আরও আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়েছি। যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তালিকা প্রস্তুত রয়েছে। কোন এলাকায় কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, তার তথ্য অনুযায়ী ওষুধ, সরঞ্জামসহ সবরকম প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।
ফেনী পৌরসভার প্রশাসক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন জানান, পৌর এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সবধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, ওয়্যারলেস যোগাযোগ চালু রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাওয়ার ব্যাংক এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার নিজস্ব নৌযান না থাকলেও প্রয়োজন হলে অন্য জেলা থেকে বোট এনে ব্যবহার করা হবে। একইসঙ্গে জেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করবে।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, ফেনীর মানুষ সাহসী। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় তারা সব সময় প্রস্তুত। যেকোনো সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত আছি।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সেক্রেটারি আনম আব্দুর রহিম বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখতে পারলে দুর্যোগ আমরা সহজে মোকাবেলা করতে পারব। এজন্য মোবাইল টাওয়ারগুলো সচল রাখতে জেনারেটর প্রস্তুত রাখতে হবে।
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন প্রতিনিধি জানায়, তারা দুর্যোগের সময় সহযোগিতার জন্য ১৫ হাজার মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের প্রস্তুতি নিয়েছে। বন্যার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, যাতে দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্ব থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেনের সঞ্চালনায় সভায় বিদুৎ বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, বিভিন্ন উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান ও জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বন্যার আশঙ্কা নিয়ে যা বলছে আবহাওয়াবিদরা
সম্প্রতি ফেনীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় আগামী ৩১ মে পর্যন্ত ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন একজন আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে আবহাওয়াবিদ উদয় রায়হান জানান, সর্বশেষ আপডেটে দেখা গেছে, মুহুরী নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ৫.৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা অংশে ৩০০ মি.মি. পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এতে ৩০ ও ৩১ তারিখে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। বর্তমানে আমবাস্যর সময় চলছে। ১ জুন থেকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতিভারী বৃষ্টিপাত হলেও পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে।
সিনিয়র আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি আজ নি¤œচাপে পরিণত হতে পারে। নিম্মচাপের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে ভারীবৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। নি¤œচাপটি খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা অঞ্চলের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে ফেনী ও নোয়াখালীতে ভারী বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে।