আজ ফেনীর রাজা খ্যাত অগ্নিপুরুষ খাজা আহমদের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৯ মে মারা যান ফেনীর এ ক্ষণজন্মা মানুষটি।
‘ফেনীর রাজা’ খ্যাত সাবেক সংসদ সদস্য খাজা আহমদ। ফেনী অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মকান্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ নাম- মরহুম খাজা আহমদ। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি এতই সাধারণ ছিলেন যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব পালনেরও সময় তিনি সংসদে যেতেন খদ্দরের তৈরি লুঙ্গি পরে। তিনি একমাত্র সাংসদ যিনি এ দুঃসাহস দেখিয়েছেন- শিখিয়েছেন নেতৃত্ব, ছিলেন নির্ভীক। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন বাঙালি আর বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী একজন। দেশের জন্য তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন একজন নিঃস্বার্থ নিবেদিত প্রাণ মানুষ হিসেবে। আজীবন ছিলেন মেহনতী মানুষের পরম বন্ধু।

গত শতকের সবকয়টি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, ছিলেন ফেনীর গণমানুষের নেতা। শুরুতেই ব্রিটিশ বিদ্রোহী হয়ে উঠেন তিনি। কিছুতেই ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ততার ফলে তিনি বেশিদূর পড়াশোনাও করা হয়নি তাঁর। ইংরেজীসহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানলেও শুদ্ধ বাংলার চর্চা করতেন, বাংলাকে ভালোবাসতেন তিনি। এরপর একে একে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সনের ৬ দফা, ১৯৬৯ সনের উত্তাল গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠকদের একজন ছিলেন মরহুম খাজা আহমদ। ফেনীর সেই সময়কার ‘মুকুটহীন সম্রাট’, খাজা আহমদ বহুল আলোচিত চোত্তাখোলায় সংগঠিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। চোত্তাখোলা তখন বড় এক ভূমিকা পালন করে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ হিসেবে। খাজা আহমদ তখন চোত্তাখোলায় প্রধান ব্যক্তি, প্রধান নেতা। চিরকুমার, লুঙ্গি এবং খদ্দরের পাঞ্জাবি পরিহিত এই মানুষটি ছিলেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। স্বাধীনতা যুদ্ধে এতদ অঞ্চলে তার অবদান চিরকাল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৯৭০ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছিলেন ফেনী জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য লড়াই করেছেন। মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে রাজপথে ছিলেন সবার সামনের কাতারে।

আপামর জনগণের বন্ধু খাজা আহমদ কিশোর বয়সেই পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উৎসর্গকৃত একজন মুসলিম যুবনেতা রূপে আবির্ভূত হন। পাকিস্তান আন্দোলনের চরম মুহূর্তে ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খাজা আহমদ ছিলেন প্রথম সারির নেতা।
যুক্তফ্রন্টের তরফ থেকে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ১৯৭০ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন পূর্বপাকিস্তান যুবলীগ ও গণতন্ত্রী পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন ফেনী মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
১৯২০ সালের ২৬ মার্চ ফেনী শহরের রামপুর সওদাগর বাড়ীতে পিতা আসলাম মিয়া ও মাতা আয়েশা খাতুনের ঘরে জন্ম নেন এ কিংবদন্তী পুরুষ। ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে চিরকাল গণমানুষের হৃদয়ে অবস্থান করবেন তিনি। ফেনীর মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবেন খাজা আহমদ।