ফেনীর ট্রাংক রোডস্থ তারা নিবাসের বিপরীতে একটি কামারশালার মালিক পলাশ কর্মকার। বংশ পরম্পরায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কামারের কাজ করছেন তিনি। এক টুকরো লোহা হাতে পেলেই বানিয়ে ফেলেন দা, বটি, চাপাতি, ছুরিসহ নিত্যব্যবহার্য লোহার সামগ্রী। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে ঢুকেছিলেন এই পেশায়, সেই থেকে আজও পৈত্রিক এই পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি।
তবে পলাশ কর্মকার এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। আধুনিকতার ছোঁয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কয়লার সংকট এবং শ্রমিক সংকটের কারণে তার মতো অনেক কামারই আর আগের মতো কাজের অর্ডার পান না। কামারের হাতুড়ির টুং টাং শব্দ আজ অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, কোরবান ঈদের মাসে একটু ব্যস্ততা বাড়ে। কিন্তু এক মাসে ব্যস্ততা বাড়লেও বাকি ১১ মাস বসে কাটাতে হয়। তখন আর তেমন কাজ থাকে না। এক সময় কামারশালায় ঢুকলেই চোখে পড়তো লাল হয়ে যাওয়া লোহার টুকরো পেটানোর দৃশ্য, হাতুড়ির শব্দে মুখরিত থাকতো চারপাশ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই চিত্র এখন বিরল। বর্তমান সময়ে ঈদুল আজহায় কিছুটা কাজ থাকলেও বাকি সময়টা অলসভাবে কাটাতে হয় পলাশ কর্মকারের মতো ফেনী শহরের অন্য কামারদের।
গতকাল মঙ্গলবার (৩ জুন) সরেজমিনে শহরের কয়েকটি কামারশালা ঘুরে দেখা যায়, হাতেগোনা কয়েকটি কামারশালাই এখন সচল আছে, তাও অর্ধেক বন্ধ হওয়ার পথে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও কয়লার সংকটে পড়ে পণ্য তৈরি ব্যয় বেড়ে গেছে। উপরন্তু আধুনিক মেশিনে তৈরি চকচকে দা-বটির দাপটে হাতে বানানো পণ্যের চাহিদা অনেক কমে গেছে।
কামারদের দেওয়া তথ্যমতে, এক সময়ের জমজমাট কামারশিল্প এখন ফেনী শহরে সংকুচিত হয়ে এসেছে মাত্র ৪০টিরও কম দোকানে। শহরের মহিপাল, লালপোল, সহদেবপুর, মাস্টারপাড়া, পাঁছগাছিয়া, বারাহিপুর ও খাজুরিয়া সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব কামারশালা। এ পেশার সঙ্গে শহরে এখনো জড়িত রয়েছেন ৫০ জনের মতো কামারশিল্পী। তবে এ পেশার জড়িত অনেকেই ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
হরিদাস নামে এক কামারশিল্পী বলেন, এই কাজ করে এখন প্রতিদিনের দোকান ভাড়া ও খাবারের খরচ বের করাটাই সম্ভব হচ্ছে না। দুই তিন বছর আগেও এক বস্তা কয়লার দাম ছিলো ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কিন্তু এখন সেই এক বস্তা কয়লার দাম হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। লোহার দামও কেজিতে বহু টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার অনেক অত্মীয় এই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিন্তু এখন আর নেই। সবাই অন্য পেশায় চলে গেছে।
শহরের খাজুরিয়ায় কামারশালায় কাজ করছেন সুকেন কর্মকার নামে আরেক কামারশিল্পী। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় রেডিমেড আধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদার বৃদ্ধির কারণে আমাদের তৈরি লোহার জিনিসপত্রের চাহিদা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে কামারশিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যাও দিনদিন কমে যাচ্ছে। তবে অনেকেই কোন উপায় না পেয়ে তাদের পৈত্রিক এ পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানায় তিনি।
নারায়ণ কর্মকার নামে একই কামারশালার আরেক কামারশিল্পী বলেন, আগে অনেক ক্রেতা ছিল কিন্তু এখন ক্রেতারা মার্কেটের আধুনিক মেশিনের সাহায্যে তৈরি দা-ছুরি বেশি কিনছেন যার কারণে আগের মতো অর্ডার পাই না। আমরা কোনো রকম এই পেশাকে টিকিয়ে রেখেছি আমাদের পরের প্রজন্ম এই পেশাকে টিকাতে পারবে না।
রঘুনাথ নামে শহরের পাঁছগাছিয়ার আরেক কামারশিল্পী বলেন, আমার পরিবার থেকে এই কাজটা চলছে, তাই আমি এখনো এই পেশায় আছি। এখন বাজারে আধুনিক পণ্য বেশি আসায় আমাদের পুরনো পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। ছোটবেলায় আমি দেখেছি, আমার বাবা আর চাচারা ঈদের সময় খুব ব্যস্ত থাকতেন। তারা দিনরাত পরিশ্রম করেও গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন আধুনিক পণ্য সহজে পাওয়া যায়, তাই আমাদের ব্যবসায় অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে। আমার অনেক সঙ্গী কামার এখন অন্য কাজ করছেন, কেউ কেউ নতুন কিছু ব্যবসায় হাত দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কামার শিল্পটি রক্ষায় সরকার উদ্যোগ না নিলে এই প্রাচীন পেশাটি অচিরেই বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।
এদিকে কামারদের এ পেশা টিকিয়ে রাখতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান শহর সমাজসেবা অফিসার শাহ কায়সার মাহমুদ। তিনি বলেন, কামারশিল্পটি একটি পেশা। এখানে সরাসরি ভাতা দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এই পেশার মাধ্যমে কামাররা আয়-রোজগার করতে সক্ষম। তবে প্রান্তিক পেশাজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় কামারদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কারণ, কামার পেশাটি সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে পড়ে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কামারশিল্পীরা আরও আধুনিক ও লাভজনকভাবে এই পেশাকে চালিয়ে যেতে পারবেন।