টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ফুলগাজী সদরের বনিকপাড়া সংলগ্ন মুহুরী নদীর ভাঙনে প্লাবিত হয় উত্তর বরইয়া, দক্ষিণ বরইয়া ও বসন্তপুরসহ চারটি গ্রাম। গত এক দশক ধরে উপজেলার দৌলতপুর, ঘনিয়ামোড়া বরইয়া ও জগতপুরের বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভাঙছে বারবার। এসব স্থানে কেন বারবার ভাঙনের কবলে পড়ে- জনপদের মানুষ এ নিয়ে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারকে দায়ী করছেন। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, নদীর নাব্যতা রক্ষা, নদী শাসন, নদীর অভ্যন্তরে দখল করে বসতি স্থাপন করা হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর গত দুই দশকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বেড়িবাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দকৃত অর্থ জনস্বার্থে শতভাগ ব্যয় না করে নিজেদের বাণিজ্যের বিষয়টি নিয়ে মনোযোগী হওয়ার ফলে দুর্বল বাঁধ নির্মিত হয় বলছেন তারা।
উত্তর বরইয়ার বাসিন্দা পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আজিজুল হক আজাদ নিজের দুইটি খামার তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, নদী ভাঙে আর আমাদের কপাল মন্দ হয়। পাউবোর দায়িত্বহীনতার টেকসই বাঁধ নির্মাণ করলে এসব স্থানে বারবার ভাঙন সৃষ্টি হতো না।
উত্তর বরইয়ার আরেক বাসিন্দা আলী আজগর আজু বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বাঁধ ভাঙলে আসে , পরে দায়সারা বাঁধ নির্মাণ করেন। ফুলগাজী বাজার থেকে জগতপুর পর্যন্ত নদীর গতিপথ, ঝোঁপঝাড় পরিচ্ছন্ন না করা ও নদীর গভীরতা না থাকায় একই এলাকায় বারবার ভাঙে।
ভাঙা বেড়িবাঁধের দক্ষিণ পাশে দেখা হয় ষাটোর্ধ বিয়াধনের সঙ্গে। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, ‘বাইত আছিলাম না, খবর হাই তড়াতড়ি আইতে না আইতে হানি আঁর ঘরে। ধান কিছু আছিলো, চাইলও আছিলো। অর্ধেক হানিত ডুবি গেছে। কাপড়-চোপড় কিচ্ছু বাঁছাইতাম হারিনো। কেয়ো খবরও লয়নো।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর) মো. ফাহাদ্দিস হোসাইন জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ দুয়েকদিনের মধ্যে সংস্কারের জন্য রাতদিন কাজ করা হচ্ছে। গোসাইপুরে ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সিলোনীয়া নদীর ভাঙা বাঁধ এলাকাবাসীর অনুরোধে নির্মাণ করা হচ্ছে না। সেই বাঁধ নির্মাণ করলে জমিতে জমে থাকা পানি নদীতে পড়বে না। পানি আটকে জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বর্তমান সরকারকে মানবিক সরকার উল্লেখ করে সরকারের নির্দেশনায় দ্রুত গতিতে রাতদিন কাজ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, আমি পুরো বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছি। নদীর বাঁধ রক্ষায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নদী পাড়ের ভেতরের বসতি উচ্ছেদ করতে হবে।
মৎস্য খাতে নির্ণয় হয়নি ক্ষতি
এদিকে এবারের প্লাবনে এলাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা। তারা বলেন, মাঠে ফসল না থাকলেও মৎস্য ঘের, পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হাসান বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. খোরশেদ আলম বলেন, মাঠে ফসল না থাকায় ক্ষতি হয়নি।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ তারেক মাহমুদ বলেন, গবাদিপশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। বসতঘরে দেশি প্রজাতির মোরগ মারা গেছে। একটি পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
জগতপুরে পানিবন্দি শতাধিক পরিবার
সদর ইউনিয়নের উত্তর বরইয়ায় মুহুরী নদীর বাঁধে ভাঙনের স্থান দিয়ে নতুন করে পানি প্রবেশ না করলেও প্রথম দুই দিনের প্লাবনে পানিবন্দি রয়েছে ফুলগাজীর উত্তর জগতপুর এলাকার শতাধিক পরিবার। গতকাল শনিবার (২১ জুন) দুপুরে উত্তর জগতপুরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে পানিবন্দি পরিবারগুলো প্রয়োজনে বের হতে পারছে না। ছোট শিশু ও নারীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন।
সেখানকার ৪৭ বছর বয়সী রাসেল জানান, আমজাদহাট-মনিপুর সড়কের জগতপুর অংশে মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি কালভার্ট বন্ধ করে দেওয়ায় পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এজন্য এলাকাবাসী স্থানীয় প্রভাবশালীদের দায়ী করেন। তারা বলেন, রাস্তা নিচু ও অপরিকল্পিতভাবে কালভার্ট নির্মাণের কারণে শতাধিক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে। গত ২০ বছর ধরে কোন জনপ্রতিনিধি এলাকায় আসেনি।
উত্তর জগতপুরের ফজু কাজী বাড়ির কৃষক কাজী ওবায়দুল হক বলেন, ৩০ শতক জমিতে ২৫ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে সবজি আবাদ করেছি। সবকিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল, জাকির, আবুল বশরও ২০ শতকেরও বেশি জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি আবাদ করে ক্ষতির সম্মুখীন হন।