আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। দিবসটি ঘিরে ফেনীর মাদক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে দৈনিক ফেনী। এতে উঠে এসেছে নানাচিত্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ফেনী জেলা কার্যালয়ের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মাদকসেবনে শীর্ষে রয়েছে ফেনী সদর উপজেলা। বিভিন্ন সময় দপ্তরটির অভিযানে মাদকসেবনের অভিযোগে সর্বোচ্চ গ্রেপ্তার হয়েছে ফেনী শহরে। সদর উপজেলার রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, রাজাঝির দিঘির পাড় ও বেদেপল্লী চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ স্পট হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকা ছাড়াও শহরের সিএনজি, রিকশা ও অটোরিকশা চালকদের অনেকেই নিয়মিত মাদক সেবন করে থাকেন।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সময়ে ফেনী জেলায় ১ হাজার ৫৯১টি মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় ২৩৮টি মামলা রুজু এবং ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

বছরব্যাপী অভিযানে সবচেয়ে বেশি উদ্ধার হয়েছে ইয়াবা ২৭ হাজার ৯৮ পিস। গাঁজা ৪৬ দশমিক ৭৭০ কেজি। এছাড়াও ৪ হাজার ৫২০ পিস টাপেনটাডল (এক ধরনের ব্যথানাশক), ১০৭ বোতল ফেনসিডিল, ৪০ লিটার চোলাইমদ, ১৭ বোতল বিদেশি মদ, ৭৩ বোতল বিলাতিমদ, ১১ ক্যান বিয়ার, ২৮৮ বোতল এনার্জি ড্রিংক্স, স্বর্ণ ২দশমিক ৮৫ গ্রাম, বুলেট ৫পিস ও ৫ লাখ ১৯ হাজার ৭০ নগদ টাকাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ফেনীর উপ-পরিচালক সোমেন মন্ডল জানান, ফেনীতে গাঁজা ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ইয়াবার সেবনও কম নয়। বর্তমানে ফেনসিডিলের বিকল্প হিসেবে টাপেনটাডল নামের একটি পেইন কিলার ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে ফেনীতে পাচার হচ্ছে এবং কিছু ফার্মেসি থেকেও উদ্ধার হয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফেনীর ছয় উপজেলার মধ্যে চারটি ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও সদর সীমান্তবর্তী হওয়ায় এসব এলাকা মাদক পাচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে টাপেনটাডল প্রবেশ করছে। এছাড়াও ইয়াবা, গাঁজা ও বিদেশি মদ ঢুকছে নিয়মিত। এছাড়াও দাগনভূঞার বেশিরভাগ জায়গায় ও মাদক পাচারকারীদের বিভিন্ন সময় আটক করা হয়।

অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশকে মাদক পাচারের জন্য ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে লালপোল এলাকায় ইয়াবার বড় চালান প্রায়ই ধরা পড়ে।

ফেনীর মাদকসেবীদের মধ্যে বেশিরভাগই ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবক। মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন উপপরিচালক সোমেন মন্ডল। তিনি বলেন, আমাদের হাতে সবসময় অভিযানের সক্ষমতা থাকলেও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে সেসব নজরে রাখতে হবে।

তিনি আরও জানান, ফেনী প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় অনেক মায়েরা সন্তানদের সঠিকভাবে তদারকি করতে পারেন না। এ সুযোগে তারা মাদকদ্রব্যে জড়িয়ে পড়ে। নিরাময় থাকলেও অনেকেই চিকিৎসার পর আবার ফিরে আসে মাদকের জগতে।

মাদক কারবারিদের এ কাজ থেকে দূরে রাখার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তারা বেশিরভাগ যুবক বয়সী। দেখা যায় ধরা পড়ার পর মাদক মামলায় জামিন নিয়ে তারা আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তাদেরকে যদি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা যায় সেক্ষেত্রে সামাজিকভাবে একটি বার্তা যাবে এবং মাদক ব্যবসা থেকে তারা দূরে থাকবে এবং অন্যরাও সে সাহস করবেনা।

ফেনীতে বেসরকারি মাদক নিয়াময় কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে কাউন্সেলিং করা হয়। কিন্তু অনেকেই চিকিৎসা শেষে পুনরায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, যা রোধে পরিবারিক সচেতনতা জরুরি। ফেনীতে ৬টি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে গেল এক বছরে ৩৩০ জনকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে, ১৭৩ জনকে কাউন্সিলিং করা হয়েছে।

গত এক বছরে ফেনীতে মাদকবিরোধী কার্যক্রমে ৩টি সেমিনার, মাদকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে স্কুলে ৩০জন প্রশিক্ষক, ৭টি স্কুলভিত্তিক আলোচনা, ১০টি ডকুমেন্টারি উপস্থাপনা এবং ৩ হাজার প্রিন্ট প্রচারণা চালানো হয়েছে। এছাড়াও স্কুল কলেজে মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্বলিত খাতা স্কেল, জ্যামিতি বক্স বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৫৬টি। তবুও মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আসছে না, বরং দিন দিন বিস্তার ঘটছে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।