ফেনী শহরের প্রাণপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত পাগলিছড়া খাল অবৈধ দখল ও দূষণে ভরাটের মুখে পড়েছে। খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে ২০ ফুট গড় প্রশস্ত খাল এখন কোথাও কোথাও ৩ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক স্থানে খালটি ড্রেন থেকেও সরু হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফেনী পৌরসভার ১০, ১১, ১২ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র প্রধান পথ এটি।
দীর্ঘদিন ধরে খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এবং খালের ওপর অবৈধ মার্কেট নির্মাণের কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে খালটি দখল ও দূষণের কারণে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে; অনেক অংশে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এদিকে ফেনী ভূমি অফিস থেকে পাগলিছড়া খালের দখল বিষয়ে জরিপ করায় সাধারণ মানুষ এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সঠিক জরিপের মাধ্যমে খালের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
একসময় পাগলিছড়া খাল দিয়ে নৌকা চলাচল করত এবং ব্যবসায়ীরা নৌকায় মালামাল আনা-নেওয়া করত। বর্তমানে খালটির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে।
গতকাল মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) পাগলিছড়া খালের আলী আজম সড়কসংলগ্ন স্থানে খাল দখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করেন মো. দিদার নামে এক ব্যক্তি। পরে স্থাপনাটি অপসারণ করা হয়। এর আগে গত সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে খালের সার্ভে করার সময় দখলের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। খালের কোনো কোনো অংশে প্রস্থ ২০, ১৮, ১৬ ও ১৪ ফুট থাকার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় খাল সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
গূত্র জানায়, সার্ভের সময় দিলদার হোসেন ও আবু বক্কর সিদ্দিকের ঘর খালের মধ্যে পড়েছে, যা ভূমি অফিস থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাগলিছড়া খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে রবিউল হক, আব্দুর রাজ্জাক ও আফাক মিয়াগণ, এবি সিদ্দিকী, মুন্সি মিয়া ও হাবিব ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে।
২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জহির উদ্দিন পাগলিছড়া খালের অবৈধ দখল ও দূষণ সম্পর্কে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, সিএস ও এসএ নকশা অনুযায়ী খালের গড় প্রস্থ ২০ ফুট হলেও বর্তমানে তা ৮ ফুটে নেমে এসেছে। ফেনী শহর পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ১ হাজার ৮০০ ফুট দৈর্ঘ্যের খালটি দাউদপুর খালের সাথে মিলিত হয়েছে। খালের কিছু কিছু জায়গা অবৈধ দখল করে কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও খালের ওপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করে ১৪ কক্ষবিশিষ্ট মার্কেট তৈরি করেছে ফেনী পৌরসভা। এতে খালের প্রশস্ততা কমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাগলিছড়া খালের ওপর নির্মিত পৌরসভার ১৪টি দোকান পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। পৌরসভা থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য মার্কেটের নিচে দুটি ড্রেন করা হলেও একটি ড্রেনের মুখ বন্ধ থাকায় পানি যেতে পারছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলা পরিষদের অর্থায়নে চার লাখ টাকা ব্যয়ে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কালভার্টের পিলারের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা আটকে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সার্ভে প্রসঙ্গে মালিক নজির আহমেদ সওদাগরগণ দাবি করেছেন, খালের প্রকৃত অবস্থান সঠিকভাবে নির্ধারণ না করলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলেন, বিএস অনুযায়ী মাপ দিলে খালের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় সঠিক হবে না। সিএস খতিয়ানের ভিত্তিতে মাপ নিয়ে প্রকৃত অবস্থান নির্ধারণ করে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করতে হবে। প্রয়োজনে খাল প্রশস্তকরণের জন্য দুই পাশে সমানভাবে জায়গা নিতে হবে।
দখলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, খালের মধ্যে আমার ঘরের অংশ পড়েছে, আমি নিজ খরচে সেটা ভেঙে ফেলব।
দিলদার হোসেন বলেন, সিএস খতিয়ানের ভিত্তিতে আমার জায়গা সঠিক রয়েছে, কিন্তু সোমবার ভূমি অফিস বিএস খতিয়ান অনুযায়ী মেপে চিহ্নিত করেছে। মঙ্গলবার দুপুরে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল সিএস খতিয়ান অনুযায়ী মেপে খালের অবস্থান নির্ণয় করা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও চাল ব্যবসায়ী জাফর আহমেদ বলেন, পাগলিছড়া খাল দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরে পানি ঢুকে যায়। ২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খালের সীমানা নির্ধারণের দাবি করছি। তিনি আরও জানান, অনেকেই খালের মধ্যে টয়লেটের পাইপ ফেলে দিয়েছেন, যা পরিবেশ দূষিত করছে।
এক শ্রমিক মো. ওসমান গনি বলেন, খালের পাশে আমরা পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকি। জুলাইয়ের ভারি বর্ষণে আমাদের বাসায় হাঁটুপর্যন্ত পানি ঢুকে পড়ে, তখন রামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে হয়।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সজিব তালুকদার বলেন, পাগলিছড়া খালের ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করতে সার্ভে চলছে। জেলা প্রশাসনের পাগলিছড়া খাল নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুরে মো. দিদার নামে এক ব্যক্তির অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। তিনি আরও বলেন, অবৈধ খাল দখলমুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ফেনীর উপপরিচালক ও পৌরসভার প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন বলেছেন, আমরা খালের দখলমুক্ত করতে ইতোমধ্যে সার্ভে শুরু করেছি। অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে সকলের সচেতনতা জরুরি।
স্থানীয়রা কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছেন, অবিলম্বে খালের অবৈধ দখলমুক্ত করে এর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সঠিক ও সুষ্ঠু সার্ভে এবং উচ্ছেদ অভিযান পাগলিছড়া খালকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।