২১ আগস্ট ২০২৪। ঘরে এক গলা পানি। পাশ্ববর্তী এক প্রতিবেশীর ছাদের ওপর আশ্রয় নেন পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের ধনীকন্ডা এলাকার নাহিদা সুলতানা। পরিবারের ছোট সন্তান, বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে পড়েন চরম ভোগান্তিতে। সঙ্গে দুইদিন ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। আবার দুপুর থেকে মোবাইল নেটওয়ার্কও ছিল না। এক বছর আগের সেই ঘটনা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। 
দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, বিয়ের পর প্রায় ১০ বছর হয়েছে এখানে স্বামীর বাড়িতে আসছি। প্রতিবছরই এখানে নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হতে দেখেছি। কিন্তু সেদিনের পানির তীব্র স্রোত সবকিছুকে হার মানিয়েছে। সবচেয়ে বড় ভয় ছিল আমার ছোট ছোট দুই সন্তান ও বয়োবৃদ্ধ শ্বাশুড়িকে নিয়ে। পুরুষ শূন্য পরিবারে তখন প্রতিবেশীরাই দূত হয়ে এসেছিল। এখনো মাঝেমধ্যে রাতে ভয়াবহ সেদিনের ঘটনা স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি। 
ফুলগাজীর ঘনিয়ামোড়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, বন্যার সঙ্গে আমরা একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু ২৪ সালের বন্যার ভয়াবহতা সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। কোনোমতে জান বাঁচিয়ে উঁচু ভবনে আশ্রয় নিয়ে কয়েকদিন ধরেই সেখানে ছিলাম। বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বেশি বিপাকে পড়তে হয়েছে। 
ফেনী সদরের ফাজিলপুর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, গেল বন্যায় ঘর ভেঙেছে, এখনো কেউ খোঁজ নেয়নি। বাঁশ-টিন দিয়ে কোনোভাবে ঘরটি মেরামত করেছিলাম। বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর পানি পড়ে। শুনেছি আমাদের ঘর করে দেবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটির বাস্তবায়ন দেখিনি। এরমধ্যে কিছুদিন আগে আবার বন্যার পানি এসেছিল, এভাবে চললে বসতভিটাও বিলীন হয়ে যাবে।
 
২০২৪ সালে সেই ভয়াবহতা আজও তাড়া করে বেড়ায় ফেনীর উত্তরের জনপদের মানুষদের। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠেন অনেকে। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে ১৯ আগস্ট দুপুর থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙন স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে তিন উপজেলার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে যায়। লোকালয়ে পানি ঢুকে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগও। ভয়াবহ এই বন্যায় বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে ২১ আগস্ট দুপুর আড়াইটা থেকে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি।
 
স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় প্রাণ হারান ২৯ জন। এছাড়াও বন্যায় সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মোটরযান, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় প্রত্যেক খাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে শত কোটি টাকা। ১৯ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এ বন্যায় গ্রাম ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবেছে জেলা শহরসহ প্রায় ছয় উপজেলাই। পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। বন্যার্ত মানুষদের উদ্ধার ও সহায়তায় এগিয়ে আসেন সারা দেশের হাজারো মানুষ।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতেই এবার আবারও টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় উজানের পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় অর্ধ শতাধিক স্থানে ভাঙনে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে।  বারবার বাঁধে ভাঙনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়সারা কাজকে দুষছেন স্থানীয়রা। 
 
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২৪ এর বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত জেলার ১ হাজার ৭১৮টি ঘরের মধ্যে সরকারিভাবে মাত্র ১১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, যা মোট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে এখনো ৯৫ ভাগ গৃহহীন পরিবার নতুন ঘরের অপেক্ষায় দিন গুনছে।এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের বসতঘর। 
ফেনী স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগের সদস্য আসাদুজ্জামান দারা ইতোপূর্বে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন না করা সম্পূর্ণভাবে সরকারের উদাসীনতা। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। ২৪ এর বন্যায় ফেনী ছিল সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ, কিন্তু সেহিসেবে কিছুই পায়নি।মানুষগুলো কষ্টের মধ্যেই থেকে গেল। বেসরকারিভাবে আমরা কিছু কাজ করেছি, তবে তা একেবারেই অপ্রতুল। সরকারের উচিত ছিল বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে সাবলম্বী করতে কাজ করা, ঘর মেরামত করে দেওয়া। 
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম ইতোপূর্বে দৈনিক ফেনীকে বলেন, ২৪ এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১১০টি ঘর নির্মাণের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ও বেসরকারিভাবে যারা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে সেগুলো আমরা ভাগ করে দিয়েছি।সরকারের কাছে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করে পাঠিয়েছি, বরাদ্দ আসলে আমরা কাজ করতে পারি। এরমধ্যে আমাদের হাতে যেটুকু থাকে সেগুলোর মধ্যে টিন দিয়ে ও আর্থিকভাবে সহায়তা আমরা প্রতিনিয়ত করি।