যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে ডাকা হতো “রিয়েল টাইগার” নামে। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই রাতে খুবই সাধারণ অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী নিয়ে অসীম ও অদ্বিতীয় সাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ঢুকে পড়েন কামালপুর বর্ডার আউট পোস্টে (বিওপি)। এটি ছিল পাকিস্তানিদের দুর্ভেদ্য শক্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে একটি। সে তুমুল বর্ষণের রাতে সালাউদ্দিন নাড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের ভিত। বীর সালাউদ্দিনের রক্ত মিশে গিয়েছিল গাঢ় সবুজ বাংলার জমিনে। সালাউদ্দিনের লাশ কিংবা কবরের সন্ধান এখনও মেলেনি।

সালাউদ্দিনের দুরন্ত শৈশব :
দাদা স্বপ্নে দেখেছিলেন নাতি হবে। তিনি নাম দিলেন মমতাজ যার অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। সালাউদ্দিন মমতাজ। ১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই ফেনী জেলার সদর উপজেলায় উত্তর চাড়িপুর গ্রামের মুক্তারবাড়িতে বাবা শামসুদ্দিন আহমেদ আর মা খায়রুন নাহারের ঘরে জন্ম নেন সালাউদ্দিন। শেষের নামটি দাদার দেয়া।
তাঁর দাদা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আকিয়াবের শেষ মুসলিম জমিদার। আর নানা মৌলভী আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। তাঁর বাবা শামসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন এডভোকেট, তিনি ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের ল’ বিভাগের ছাত্র। বাবার ওকালতির সুবাদে সালাউদ্দিনের শৈশব শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তার পরিবার চলে আসে ফেনীতে। দেবীপুর প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় সালাউদ্দিনের। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন সালাউদ্দিন।
পারিবারিক কারণে অতিথিতে নিত্য ভর্তি থাকত তাদের বাড়ি। কাজের লোকেরা বড় ফাঁকিবাজ তাই মা খায়রুন নাহারকে সবদিকে নজর দিতে হত। দুহাতে সামলাতে হত বাড়ির প্রতিটি দিক। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা সালাউদ্দিনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
সন্ধ্যে নামলেই ঘরে ঘরে কুপিবাতি। ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে উঠোনের এক কোণে সাদা কাপড় গায়ে চাপিয়ে ভূতের ভয় দেখানোর সেকি নিরন্তন প্রচেষ্টা তাঁর। একবার হলো কি বেড়াতে আসা খালাতো বোন সাদা কাপড় গায়ে লম্বা মতন মানুষ দেখে জায়গায় ফিট। পরের তিনদিন জ্বরে কাবু হয়ে প্রলাপ বকতে থাকলো সেই খালাতো বোন।
মেধাবী কিন্তু চঞ্চল ছিলেন সালাউদ্দিন
এমনই চলছিলো সালাউদ্দিনের জীবন। তখন মফস্বলের নামকরা স্কুল ফেনী পাইলট হাই স্কুল। সেখানে থেকে মেট্রিক সম্পন্ন করেন সালাউদ্দিন। গোটা জেলা তো বটেই কুমিল্লা বোর্ডে ফলাফলে প্রথম দিকে থাকলেন সালাউদ্দিন। কিন্তু ততদিনে তাঁর দুষ্টুমি বেড়েছে শতগুনে। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া পেরোনোর আগেই দুষ্টুমির চোটে লাহোরে পাঠাতে বাধ্য হলেন বাবা। এবার লাহোরের দয়াল সিং কলেজ। কলেজের মেধা তালিকায় প্রথম দিকেই ছিল তাঁর অবস্থান। গোটা কলেজে মোটে মিলে বাঙ্গালী চারজন। উর্দুটা প্রথম প্রথম বেশ খিটখিটে লাগতো, কিন্তু কদিন বাদে বেশ রপ্ত হয়ে গেলো। ক্লাসের ছাত্রদের ওপর ভীষণ প্রভাব। তাঁর জন্য সবাই সব করতে রাজি। এসব কারণে তাকে সেখানে থেকে নিয়ে আসা হয় ফেনী সরকারি কলেজে। সেখান থেকে আইএসসি পাশ করে ভর্তি হন বিএসসিতে।
১৯৬৬ সালে বিএসসি পড়াকালীন সময়ে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেব সালাউদ্দিন যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। সেখানে থেকে তাকে বদলি করা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইনফ্র্যান্টি ডিভিশনে। বন্ধুদের আড্ডার প্রাণ সালাউদ্দিন। একজন যদি বলে চা চলবে, তাঁর প্রতিউত্তর কেন কফি খাওয়া নিষেধ। একবার বাড়ি এলে আর ফিরে যেতে মনে চায় না। যাওয়ার বেলায় মায়ের সেকি আকুতি। বাক্স পেটারা ভর্তি, চিঁড়ে আর মোয়া। ছেলে কবে ছুটি পায়। আর যেদিন ছুটিতে দেশে আসা হয় এক সপ্তাহ আগে থেকে মায়ের সেকি প্রস্তুতি। ছেলে আসবে, প্রাণের ছেলে প্রিয় ছেলে।
১৯৬৭ সালে ২৭শে আগস্ট কাকুলের পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমী থেকে ১২৪ জন ক্যাডেটের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করে ক্যাপটেন র‌্যাংকে কমিশন পেয়েছিলেন সালাউদ্দিন। এরপর তাঁর পোস্টিং দেয়া হয় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর পাকিস্তানের মারিতে স্কুল অব মিলিটারি ইনটেলিজেন্সে কোর্স শেষ করার পরে ১৯৭১ সালের ৩ মে ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে বদলি করা হয় সালাউদ্দিনকে।

দুর্ভেদ্য পাকিস্তান সেনানিবাস থেকে পলায়ন :
১৯৭১, গোটা দেশে তখন তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দামামা বাজছে। বাড়ি থেকে কোন খবর নেই। মা বাবা বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে। রাত্রির ঘুম দুচোখের পাতায় একত্র হয় না সালাউদ্দিনের। একপাশে প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি অবিনশ্বর টান আর অন্যদিকে প্রাণের মায়া। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে তাঁর দুদিন পরে মাতৃভূমির জন্য ক্যান্টনমেন্টের উঁচু প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পালালেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ খায়রুল আনাম, ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ। তাঁদের এই আগমন ঝড় তুললো গণমাধ্যমে। শিরোনাম ‘পাকিস্তানের দুর্ভেদ্য ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে পাঁচ বাঙ্গালী অফিসার’। (সূত্র: ডেইলি স্টার, জুলাই ১২, ২০২১)
৩ জুলাই দুর্গম পার্বত্য এলাকা এবং পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কাছে মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন তারা। এই নদী অতিক্রম করে সীমান্ত পাড়ি দেয়া ছিল প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক। ধরা পড়লেই ফায়ারিং স্কোয়াডে নিশ্চিত মৃত্যু। একপ্রকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্ত ধোঁকা দিয়ে ভারত সীমান্তের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর দিয়ে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করেন।
এসময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ বাকিদের সঙ্গে অস্ত্র বলতে ছিল কেবল পিস্তল। সেখান থেকে তাঁরা বিএসএফ ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার হয়ে দিল্লি এসে এরপর দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছান। কলকাতায় আসার পর মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এমএজি ওসমানী নিজে এই পাঁচজনকে বরণ করে নেন। এর আগে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পূর্বে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত থাকায় তাঁকে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী ১১নং সেক্টরে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬৭ সালের ২৭শে আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন সালাউদ্দিন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালা ক্যাম্পে এ রেজিমেন্টের অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং চলছিল। এখানে পরে জেড ফোর্স গঠিত হলে তাঁকে এই ফোর্সে নিযুক্ত করা হয়।

কামালপুরে পাকিস্তানি ঘাঁটি :
প্রশিক্ষণ শেষে ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধ উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য কনভেনশনাল ওয়্যার বা প্রচলিত ধারার যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন। এতদিন এ ব্যাটালিয়নগুলো কেবল গেরিলা যুদ্ধই করেছে। মেঘালয় সীমান্তবর্তী জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নের বর্ডার আউটপোস্টে (বিওপি) আক্রমণ ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমে কামালপুর বিওপি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন জিয়া। সালাহউদ্দিনকে “চার্লি” কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও লে. মান্নানকে কামালপুর পাকিস্তানি অবস্থান রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৮ শে জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও তাঁর দলের লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান, সুবেদার হাই, সুবেদার হাসেম ও নায়েক সফিকে নিয়ে কামালপুর বিওপি রেকি করতে যান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি লিসনিং পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছালে একজন পাকিস্তানি সেনা ‘হল্ট’
বলেই চিৎকার দিয়ে ওঠেন। সেসময় তার সঙ্গে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. আবদুল মান্নান (পরে লে. কর্ণেল), যিনি বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন। সেদিনের বিবরণ দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে (৮ মার্চ, ২০২২) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-
‘সেখানে ছিল দুই পাকিস্তানি সেনা। দুজনের একজন হল্ট বলে চিৎকার করে উঠল। ঐ পাকিস্তানি সেনাকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন সালাউদ্দিন মমতাজ। আবদুল মান্নান তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, গুলি করলে সালাউদ্দিন মমতাজও মারা যেতে পারেন। তাই বন্দুকের নল ঠেকালেন ঐ পাকিস্তানি সৈন্যের পাঁজরে। বুঝতে পেরে ঐ সৈন্য মমতাজকে ছেড়ে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গুলি করলেন ঐ সৈনিককে। ঘটনার আকস্মিকতায় অপর পাকিস্তানি সেনা হতভম্ব। প্রতিরোধের সুযোগ না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকেও হত্যা করলেন। এরপর তারা দুই পাকিস্তানি সেনার মাথার ক্যাপ ও অস্ত্র নিয়ে ফিরে এলেন নিজেদের শিবিরে।’
এদিকে হঠাৎ আক্রমণ ও দুই সেনার নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ণ সতর্ক হয়ে যায়। তারা ভেবেছিলো এটি নিশ্চয়ই ভারতীয় বাহিনীর কাজ। কারণ মুক্তিবাহিনী এধরনের হামলা করবে তা তাদের চিন্তার বাইরে ছিলো। তাও আবার এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে গুলি করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া! ভারতীয় বাহিনী ফের আক্রমণ করতে পারে এই ভেবে ঢাকা থেকে বিপুল পরিমাণ সৈন্য পাঠানোর আহ্বান জানায় কামালপুর বিওপি। পরদিন ঘটনা শুনে জরুরীভাবে ঢাকা থেকে কামালপুরে আসেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী। তার নির্দেশে এবার দ্বিগুণ সৈন্য ও অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠানো হয় কামালপুরে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

ডেডলাইন ৩১ জুলাই:
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সন্দেহাতীতভাবে অপারেশন কামালপুরকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। কামালপুর যুদ্ধের সবচেয়ে দুরূহ ও বিপজ্জনক যুদ্ধ ছিলো ৩১শে জুলাইয়ের এ যুদ্ধ।
৩০-৩১শে জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আঁধারে রওনা হলো। প্রথমে সালাউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানী, ফলোআপ কোম্পানী হলো ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্র্যাভো, যার পিছনে হল ব্যাটালিয়ন ‘আর’ গ্রুপ এবং এই ‘আর’ গ্রুপে ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঈন এবং সাথে ছিলেন কর্নেল জিয়াউর রহমান।মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রথম সারির প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পেছনে সরে যায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী সৈনিকরা শত্রুর বাংকার অতিক্রম করে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়ে এবং হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। সুবেদার হাই এর নেতৃত্বে যে প্লাটুনটি যুদ্ধ করছিল তারা মাইন ফিল্ডের সামনে পড়ে যায়। এই প্লাটুনের ডানে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও তার সহযোগীরা।
‘শত্রু আমাকে দেখে ফেলবে সে চিন্তা করোনা, আমি এই রং এর শার্ট পড়ছি যাতে রাতের আঁধারে তোমরা আমাকে দেখতে পাও’- কামালপুর আক্রমণের পূর্ব তার সৈন্যদের বলছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ। সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিতেন সালাউদ্দিন। তাই আক্রমণের সময় তার নিজের সৈনিকরা যাতে দিকভ্রান্ত না হয় এবং পেছনে থেকে অনুসরণ করতে পারে সে কারণেই প্রচলিত যুদ্ধের সব নিয়ম ভেঙ্গে যুদ্ধে পড়েছিলেন একটি হালকা রঙের শার্ট।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিছুটা এগিয়েছে, অমনি পাকিস্তানি আর্টিলারির সালভো ফায়ার এসে পড়ল। হতোদ্যম মুক্তিসেনারা মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। সেনাদের চাঙা করতে সালাউদ্দিন তখন পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্যে মেগাফোনে উর্দুতে বলছেন, 'আভিতক ওয়াকত হায়, শালালোক সারেন্ডার করো। নেহি তো জিন্দা নেহি ছোড়েঙ্গা।’
মুক্তিবাহিনী ঝড়ের মতো ছুটে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাঙ্কারগুলো গুঁড়িয়ে দিল। ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অবিশ্বাস্য সাহস দেখিয়ে সোজা নিকটস্থ কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়লেন। ‘প্রচন্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবায় যত্রতত্র ভূপাতিত পাকিস্তানি সেনারা। পেছনে তখন আমাদের পরে লাশ আসা শুরু হয়ে গেছে।’
সালাউদ্দিন বুঝতে পেরেছেন শত্রুরা পিছু হটে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্ততি নিচ্ছে। তিনি সুবেদার হাইকে বললেন প্লাটুন নিয়ে ডানে যেতে। সালাউদ্দিন শত্রুর পিছু নিয়েছেন। সেনারা তাঁকে মিনতি করছে, ‘স্যার, পজিশনে যান। মানে মাটিতে শুয়ে পড়ুন।’ সালাউদ্দিন ধমকে উঠলেন, 'চিন্তা করিস না তুই, বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি।’
যাও যাও, প্রচন্ড গর্জনে সালাউদ্দিন বলছেন। তিনি সঙ্গীদের সরিয়ে দিয়ে একাই লড়ে গেলেন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। আর সঙ্গে চিৎকার, জয় বাংলা, জয় বাংলা। একটানা চলছে মেশিন গানের অবিরাম গুলি। আর অন্যপাশে পিছু হটছে পাকিস্তান বাহিনী। খানিক বাদে শত্রুবোমা সালাউদ্দিনের ঠিক সামনে এসে পড়লো, গাঢ় রক্তে
রঞ্জিত হলো সালাউদ্দিনের শার্ট। তখনো সালাউদ্দিনের একটানা চিৎকার। জয় বাংলা, জয় বাংলা।


কামালপুরের যুদ্ধ সম্পর্কে সেদিন সালাউদ্দিনের সহযোদ্ধা ও বি কোম্পানীর কমান্ডার মেজর হাফিজ তার ডায়রিতে লিখেছেন-“৩১ শে জুলাই ১৯৭১। আজ ভোর তিনটায় কামালপুর বি ওপি-এর ওপর মেজর মঈনের নেতৃত্বে আমরা কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ করলাম। আমি ‘ই’ কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ‘D’ কোম্পানী নিয়ে প্রচন্ড হামলা চালালাম। কয়েকজনের কাপুরুষতার জন্যে আমাদের আক্রমণ সফল হল না। আমাদের ৩০ জন শহীদ এবং ৭০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। মাত্র চল্লিশ গজের ব্যবধান ছিল আমাদের এবং শত্রু পক্ষের প্রধান ঘাঁটির মধ্যে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, আমার প্রিয় বন্ধু বীরত্ব ও সাহসিকতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শত্রুর মর্টারের শেলের আঘাতে শহীদ হলেন। আমার নিজের শরীরে ছয় জায়গায় মর্টারের গোলার টুকরার আঘাত লাগে। আমাকে তুরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। লে. মান্নানের ডান উরুতে গুলি লাগায় সেও হাসপাতালে ভর্তি হল। আমার প্রিয় ড্রাইভার সিরাজও শহীদ হল। শত্রুপক্ষের চল্লিশজন নিহত হয়। আমাদের পল্টনের অফিসারদের মধ্যে ওই সব চাইতে প্রিয় ছিল ট্রুপস-এর কাছে। সালাউদ্দিনের পবিত্র কোরআন শরীফখানা আমার কাছে রয়ে গেল। ওর কথা মনে হলেই আর চোখের পানি রাখতে পারি না, মনে হয় ও মরেনি। দিতে দিতে, খানেদের দিকে আগাই যাইতেছিলেন। এক্কেরে ফাঁকা আসমানের তলে। তাঁর ধারে কাছে কোন আড় আছিল না”। একটু আগে তিনি ক্যাপ্টেন হাফিজের কাছেও এই কথা শুনেছেন। তারপরও তাঁর শোনার আগ্রহ কমছিল না।
ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের মায়ের আসার খবর শুনে, ইউনিটে উপস্থিত সবাই জড়ো হয়েছিল তাঁকে দেখার জন্যে। সালাহউদ্দিন স্যার তাঁদের প্রিয় কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। লাহোরে পোষ্টিং ছিল তাঁর। যুদ্ধে আসার কোন দরকারই ছিল না। তবুও তিনি এসেছিলেন। শেয়াল কোটের পাহাড়ি নদী মনোয়ারই তাবি ঝাঁপিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌছে ছিলেন। সেখান থেকে তেলঢালা। তাঁর প্রিয় ফার্স্ট বেঙ্গল। বাড়িও যাননি। মা অপেক্ষা করবেন জেনেও। মা বললেন, “পোলাডিরে আমি শেষ দেখছিলাম, লাহোরে ট্রেনিংয়ে যাওনের আগে। হ্যার কি মা’র কথা মনে অয় নাই?” পাকিস্তানিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে যাবার পর, মফিজুল তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে মুখে পানি দিতে দিতে বলেছিল, “স্যার কলেমা পড়েন”। তিনি বললেন, “আমার কলেমা আমি পড়ব, যদি টার্গেট দখলের আগে ভাগোস তরেও কিন্তু ছাড়ুম না”। সেই তার শেষ কথা। মফিজুল সালাউদ্দিনের মা�