মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে কত মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছেন তার কোন সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সেই সময়কালীন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে এ অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছে দৈনিক ফেনী। ইতিহাসের সেই অজানা দিক উন্মোচনে আজ ৬ ডিসেম্বর ‘ফেনী মুক্ত দিবসে’ পড়ুন দৈনিক ফেনীর বিশেষ প্রতিবেদন ⇒
নোয়াখালী জেলায় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে ৭৫ হাজার বাঙালি নিহতের তথ্য জানিয়েছেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ প্রকাশিত একটি সংবাদে এ তথ্য মিলেছে। মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয়ের পর ফেনী থেকে যুদ্ধকালীন ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষ উদ্বাস্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। সে সময়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ফেনীতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই সময়ের গণমাধ্যম উঠে এসেছে কেবল ফেনী কলেজ বধ্যভূমিতে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।
এনা’র (সংবাদ সংস্থা) বরাত দিয়ে দৈনিক আজাদ প্রকাশ করে, জাতীয় পরিষদ সদস্য ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল গণমাধ্যমটিকে জানায়, জেলা জুড়ে সফর শেষে ৭৫ হাজার মানুষ হত্যার তথ্য মিলেছে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের যে ইতিহাস উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, তৎকালীন নোয়াখালী জেলায় সর্বাধিক যুদ্ধ এবং হত্যাযজ্ঞ ঘটে ফেনীতে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের দিকে ফেনীতে প্রবেশের পর ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হওয়া পর্যন্ত ফেনীতে নৃশংস বর্বরোচিত গণহত্যা, অত্যাচার ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাহিনী।
দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৩শে এপ্রিল পাক-হানাদাররা ফেনী মহকুমায় প্রবেশ-কালে সর্বপ্রথম দরবেশ আবদুল কাদেরকে গুলী করে হত্যা করে। তারা ফেনী শহরে প্রবেশকালে দেওয়ানগঞ্জ, আমতলী ও শহর-তলীতে কয়েকশত লোককে হত্যা করেছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জের ট্রাঙ্করোডের পার্শ্বে বহু নরকঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখা যায়। শহর উপকণ্ঠে একটি সরকারী ভবন সংলগ্ন বধ্যভূমিতে শত শত দেশপ্রেমিককে ধরে এনে হত্যা করা হয়। একই সময়ে বর্বরেরা মার্চেন্ট সমিতির কর্মকর্তা আবদুস সাত্তারকে অপর ৮ জনের সঙ্গে বেঁধে গুলী করে হত্যা করে। ফেনী কলেজের পার্শ্ববর্তী একটি গোপন বধ্যভূমিতে বাহির থেকে বহু লোক ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। এদৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী একজন রেলকর্মীর কাছ থেকে এ সংবাদ জানা গেছে। পুলের অগণিত নদীতে জনৈক এছাড়া ধুমঘাট রেলওয়ে পার্শ্বে বৃদ্ধ, যুবক ও বালককে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছে। উর্দুভাষী স্টেশনের অদূরে এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বাড়ীতে তিনটি বয়স্কা মেয়েসহ আশ্রয় নিয়েছিলো। হানাদারেরা তাকেও রেহাই দেয়নি। পরিবারের সকলকে হত্যা করে আর মেয়ে তিনটিকে নিয়ে যায়। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। পাক-বর্বরেরা ধুম এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ ৩ শতাধিক লোককে হত্যা করে আর ১০২টি ঘর ভস্মীভূত করে। মে মাসে ফেনী রেল ষ্টেশনের পিছনের ডোবায় বহু অফিসারকে হত্যা করে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
পাক-হানাদারদের সহায়তায় এগিয়ে এসে ছিল কুখ্যাত প্রশাসক বেলাল আহমদ খান। ফেনীতে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় ও লুণ্ঠনকাজে নেতৃত্ব দিয়েছিল সে। ব্যক্তিগত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে সে বহুবিশিষ্ট লোককে হত্যা আর তাদের বাড়ীঘর বিধ্বস্ত করতে সহায়তা করছে। রাজাকার ও বদর বাহিনীর শয়তানেরাও বহু লোককে হত্যা করেছে। ফলকথা ফেনী এলাকার খাল বিলে নদীতে মাছ ধরার আর বিশিষ্ট সময় এখনও বহু নরকঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা গেছে।’’
