মুক্তিযুদ্ধে ফেনী সরকারি কলেজ বধ্যভূমিতে কত মানুষকে গণহত্যা করা হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য কোথাও মেলেনি। তবে সেই সময়কালীন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফেনীতে পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতার কিছু তথ্য উপাত্ত খুঁজে পায় দৈনিক ফেনী। ইতিহাসের সেই অজানা দিক উন্মোচনে আজ ৬ ডিসেম্বর ‘ফেনী মুক্ত দিবসে’ পড়ুন দৈনিক ফেনীর বিশেষ প্রতিবেদন ⇒

১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘‘ফেনী কলেজ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন কবর থেকে তিন হাজার নরকঙ্কাল আবিস্কার করা হয়েছে।’’

সংবাদটিতে আরও বলা হয়, ‘‘একটি চলচ্চিত্র দল গত ৯ মাসে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর বর্বরতার বাস্তব নিদর্শন সংগ্রহের জন্যে এখানে এলে উক্ত কঙ্কালসমূহ পাওয়া যায়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফেণী কলেজ ময়দানে ও ফেনী ও থানা ট্রেনিং উন্নয়ন কেন্দ্রের সম্মুখে অবস্থিত পাইকারী কবর অনুসন্ধানকালে প্রতি কবরে কয়েক ডজন নর-কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এসব কবরের মধ্যে ছাত্র শিক্ষক সহ নির্দোষ নাগরিক-দের লাশ রয়েছে। মুক্তি বাহিনী সন্দেহে বহু সংখ্যক লোককে বাড়ী থেকে ধরে আনার পর হত্যা করা হয়। এছাড়া বহু লোক ফেণী হয়ে তাদের বাড়ী ও নিয়োগস্থলে যাবার পথে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে পড়ে এবং তাদের হত্যা করা হয়। ফেণী মহকুমার বিভিন্ন স্থানে এখনো শত শত পাইকারী কবর অনুদ্ঘাটিত রয়েছে। সেখানে দখলদার বাহিনী বহু নিরীহ লোককে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে কাউকে গুলী করে পানিতে ডুবিয়ে দেয় কাউকে গাছে দড়ি বেঁধে ফাঁসি দেয়া হয় এবং কাউকে জীবন্ত অবস্থায় বস্তাবলী করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে, ঝোপ জঙ্গলে ও নদীর পারের ক্ষেতে মাঠে অসংখ্য কবর থেকে অজস্র নরকঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে।’’

ফেনীতে নির্মম গণহত্যার তথ্য পাওয়া গেছে বীরমুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানেও। মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, একাত্তরে ফেনী কলেজের মাঠ ছিল পাকিস্তানিদের নির্যাতনের অন্যতম কেন্দ্র।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের ২নং সাব সেক্টর কমান্ডার ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রম বলেন, ‘‘ফেনী কলেজের নির্দিষ্ট কোন স্থানকে বধ্যভূমি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কলেজ মাঠ, পাইলট স্কুল মাঠ, ডোবা, কলেজ সীমানা লাগোয়া স্টেশন রোড সর্বত্র মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে পুঁতে রেখেছিল পাকিস্তানিরা। ঠিক কত সংখ্যক মানুষকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে তার নিরূপণ সম্ভব নয়।’’

ফেনী কলেজ বধ্যভূমি প্রসঙ্গে তৎকালীন বিএলএফ জোন ডি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জয়নাল আবদিন (ভিপি জয়নাল) ইতোপূর্বে দৈনিক ফেনীকে জানান, ফেনী পাইলটের পূর্বদিকের কলেজের মাঠের দিকে দুর্গন্ধের জন্য যাওয়া যেত না, আর শুধু লাশ আর লাশ। কারও পা, কারও মাথা দেখা যাচ্ছে। পাকবাহিনী ফেনী ত্যাগ করার আগে নির্বিচারে এখানে নেতৃস্থানীয়, দলীয়, যাকে শত্রু মনে করেছে তাকে ধরে এনে হত্যা করেছে। সেখান থেকে প্রায় এক ট্রাকের মত নরকঙ্কাল শহিদ মিনারে জড়ো করা হয়েছিল। সেখান থেকে সেগুলো জাদুঘরে নেওয়া হয়।

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে ফেনী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক তায়বুল হক বলেন, জানুয়ারির শুরুতে কলেজের বর্তমান শহীদ মিনারের বেদীর পাশে স্তুপাকৃত মানুষের হাড়গোড়-খুলি দেখেছি। হাড়গোড় সম্পর্কে একটি সত্য ঘটনা রয়েছে। ‘একদিন এক ব্যক্তি শহীদ মিনার বেদীতে এসে একটি খুলি নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। এটি দেখে দায়িত্বরতরা তাকে গতিরোধ করলেন। সোনাগাজী থেকে আসা ওই ব্যক্তি বলছিলেন, খুলিটি আমার ভাইয়ের। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমার ভাইকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছিল। এরপর আর সে ফিরে যায়নি। আমার ভাইয়ের মাথা বড় ছিল। এ খুলিটি আকারে বড়। এটি আমার ভাইয়ের মাথা।’

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, যুদ্ধ শেষে কলেজের ভেতরের অংশে অসংখ্য মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়। তবে কাদের এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে তা অজানা রয়ে গেছে।

একইভাবে ফেনী কলেজে নির্মম হত্যকাণ্ডের কথা জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফেনী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান। তিনি জানান, কলেজ মাঠের একদম দক্ষিণের গোলপোস্টের নিচে অনেক লাশ পেয়েছি। এক কোণে ২০-২৫ টা লাশ দেখেছি। লাশ মানে হাড়গোড়। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে সাংবাদিকরা গিয়ে ছবি তুলে এনেছে। কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য নেই। তবে এখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গোলপোস্টের পেছনের অংশ ছাড়াও মাঠ লাগোয়া রেলওয়ের ডোবাতেও লাশ পঁচে-গলে ছিল। এখন যেখানে অডিটরিয়াম রয়েছে সেখানেও মানুষের কঙ্কাল মিলেছিল।

ফেনী কলেজ বধ্যভূমি প্রসঙ্গে ফেনী ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার শাহ আলম বকুল বলেন, তখন স্কুলে পড়ি। ৬ ডিসেম্বর সকালে মানুষ ছুটছিল ফেনী কলেজের পেছনের অংশে। তাদের দেখে আমিও ছুটলাম। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা কলেজের ভেতরের মাঠে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তখন মাস্টারপাড়ার ভেতর দিয়ে কলেজের পেছন দিক দিয়ে ঢুকি। দেখতে পাই, মাঠের দক্ষিণ গোলপোস্টে ফাঁসির দড়ি ঝুলে আছে। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পড়ে আছে। তীব্র পঁচা গন্ধে কাছে যাওয়া কষ্টকর হচ্ছিল। এখানে অনেকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বলে পূর্বেই শুনেছিলাম। মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে হত্যার কথাও শুনেছিলাম। একাত্তরের অক্টোবরে একদিন ফেনী রাজাঝির দিঘির পূর্ব পাড় দিয়ে সন্তপর্ণে যাওয়ার সময় ফেনী পাইলট হাই স্কুলের বাস্কেটবল মাঠে খাঁচায় বন্দী বাঘ দেখেছিলাম। বাইরে থেকে জাল দিয়ে খাঁচা ঢেকে রাখা হয়েছিল।