সেদিন সকালটা এসেছিল অন্যরকম ভাবে। ৯ মাসের ভীষন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত, বিধ্বস্ত এ রক্তাক্ত জনপদে সেদিন এসেছিল প্রতিক্ষিত 'মুক্তি'। অনেক রক্তের স্রোতে ভেসে, অনেক আত্মত্যাগ- গণহত্যার শোক বুকে নিয়ে এ মাটিতে উড়েছিল স্বাধীন এক লাল সবুজ বিজয় নিশান।
১৯৭১, ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিল ফেনী। ফলে সেদিন সকালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে অনেকেই হকচকিত হয়ে ওঠেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ স্লোগান প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেননি- সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন।
৬ ডিসেম্বর সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেঃ কর্ণেল (অবঃ) জাফর ইমাম তাঁর ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ বইতে লিখেন, ‘বিজয়ের বেশে আমরা যখন ফেনী প্রবেশ করলাম ক্ষণিকের মধ্যে ফেনী শহরে জনতার ঢল এসেছিলো। শুরু হয় বিজয় মিছিল। জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। রাস্তায় জনগণ যেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে সেখানেই তাৎক্ষণিক তারা আলিঙ্গন করে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। অনেকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে কোলে করে রাস্তা পরিদর্শন করছিল। রাস্তার দুপাশ থেকে জনতা দু’হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। মিছিলে মিছিলে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকা। অনেককে বিজয়ের আনন্দে কাঁদতে দেখেছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে খাজা সাহেব (খাজা আহম্মদ) কিছুক্ষণ পর ফেনী পৌঁছেছিলেন। আমার সাথে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর বৃহত্তর অংশ ফেনী প্রবেশ করে। ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের পেছন থেকে আমাদেরকে অনুসরণ করে ও ফেনী অভিমুখে যাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ফেনী কলেজের প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান খান, তৎকালীন ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবদীন হাজারী, গোলাম কাদের আরও অনেকেই আমাদের সাথে ছিলেন। ফেনীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় একই সময়ে শহরে প্রবেশ করে ভিপি জয়নাল, করিম হাজারী, নুর মোহাম্মদ হাজারী, মোঃ সালেহ আহম্মদ সালু, আবদুল মোতলেব, কাজী নুর নবী, শ্যামল বিশ্বাস, এডভোকেট মুসা মিয়া, জাহাঙ্গীর কবির। সবাই সেদিন বিজয়ের আনন্দে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।’
সেদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে পাক হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে ফেনীর সব সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এ সংবাদ শুনেই জয় বাংলা শ্লোগান ও করতালির মধ্য দিয়ে ফেনীর রাজাঝির দিঘীর পাড়ে সার্কিট হাউজে ও ট্রাংক রোডের প্রেস ক্লাব ভবনের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা ও হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ একত্রিত হতে থাকে।
তিনি জানান, ২নং সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী লেঃ কর্নেল (অবঃ) জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সকালেই ফুলগাজীর বন্দুয়া থেকে এসে ফেনী সার্কিট হাউজে (বর্তমান ফেনী সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউজ) প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিকালের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক জয়নাল আবদীন ভিপির নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী রাজাপুর, কোরাইশ মুন্সী ও সোনাগাজীর নবাবপুর থেকে ট্রাংক রোডে চলে আসে। সন্ধ্যায় সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা সমাবেশ করেন।
গেরিলা যুদ্ধের বিবরণ দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবদীন ভিপি বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতেই গেরিলা যুদ্ধের নীতি ‘হিট অ্যান্ড রান’ প্রয়োগ করে যুদ্ধ করতে করতে আমরা পাঁচগাছিয়া এলাকার কাছাকাছি চলে আসি। রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এদিকে এসে হিট (হামলা) করে আবার চলে যাই। ৫ ডিসেম্বর আমরা ঠিক ফেনীর কাছাকাছি যখন আসি তখন পাক সেনাবাহিনী রণভঙ্গ দিয়ে শেষ রাতের দিকে শুভপুর ও বারইয়ারহাট হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ফেনীর আশপাশে থাকা পাক বাহিনী কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। তখন আমাদেরকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয় শহরের দিকে আসতে। বিলোনিয়ার দিক থেকে জাফর ইমাম ও সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলামরা সবাই শহরের ট্রাংক রোডে প্রবেশ করল। আমরা পশ্চিম দিক থেকে এসে তাদের সাথে মিলিত হলাম। সেই থেকে ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল।
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতকি সংগঠন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ফেনী মুক্ত দিবসে শহরের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আলোকসজ্জা করা হবে। আজ সকালে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরে র্যালী বের করা হবে। র্যালি শেষে আলোচনা সভা এবং বিকালে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি পালনে ফেনীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
