আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে ফেনীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মনিরা হক। এছাড়াও নির্বাচন ও গণভোট নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে গ্রহণে পুলিশ এবং অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। গতকাল রোববার (২১ ডিসেম্বর) সকালে নিজ সম্মেলনে কক্ষে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে এসব নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক।

সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট রয়েছে। সরকারি ডাকবাংলোগুলো কোনোভাবেই প্রার্থীদের প্রচারণা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুল পর্যায়ে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও সচল রাখতে হবে। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নাইটগার্ডদের আরও সজাগ থাকতে হবে এবং প্রত্যেকটি সরকারি অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় জেলার বাইরে সরকারি বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও নির্বাচনী কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের পোস্টাল ব্যালটে নিবন্ধন করার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সকলকে সতর্ক থেকে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক।

জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় পরিবেশ সুরক্ষা, জলাবদ্ধতা নিরসন, অগ্নি নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সংগ্রহ, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, পরিবেশ ঠিক রাখতে বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পৌরসভাকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ছোট নদী ও খালের ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। জেলা পরিষদের সামনে সীমানা প্রাচীর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের সামনে ড্রেন সংস্কারের বিষয়ে পৌরসভাকে ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি।

প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, স্কুলগুলোতে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিয়মিত পরিদর্শন প্রয়োজন। পরিদর্শনে শিক্ষার্থীরা উজ্জীবিত হয়। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত টুল পূরণ করার আহবান জানান তিনি।

পৌর এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, কোনো পৌরসভায় গভীর নলকূপকেন্দ্রিক গর্ত থাকলে তা দ্রুত ভরাট করে ফেলতে হবে। পাশাপাশি ড্রেনের স্ল্যাব খোলা রাখা যাবে না, এতে জনসাধারণের বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। রাজশাহীর মতো ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির উদ্দিন বলেন, বর্তমানে কোনো ড্রেন স্ল্যাববিহীন নেই। আগামীতেও কোনো ম্যানহোল বা ড্রেন স্ল্যাব ছাড়া থাকবে না বলে জানান তিনি।

সভায় ফেনীতে অগ্নি নিরাপত্তা প্রসঙ্গে আলোচনা করেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, ফেনী বড় বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও কেমিক্যাল গোডাউনের তালিকা সরবরাহ করতে হবে। বাজারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কেন হচ্ছে এবং যাদের অবহেলার কারণে এসব ঘটছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে বাজারে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভারের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন তিনি। বাজার এলাকায় আগুন লাগার প্রবণতা থাকায় ব্যবসায়ী সমিতিসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সভায় প্রত্যেকটি সরকারি দপ্তরে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত আহবান জানান তিনি।

সভায় ফেনী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা জানান, বড় বাজার এলাকায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে সমস্যা হয়। জলাশয়ের ব্যবস্থা না থাকায় দূর থেকে পানি আনতে হয়, যা ফায়ার সার্ভিসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

জেলা প্রশাসক বলেন, পাগলিছড়া ও দাউদপুল খাল সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি শহরের মূল সড়ক সংলগ্ন ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেন তিনি। এসময় তিনি সোনাগাজীর কুঠিরহাট নদীর উপর নির্মিত ব্রিজ রক্ষায় নদীতে বালুর পরিমাণ নিরূপণে জরিপের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেন। জরিপ প্রতিবেদনের আলোকে বালুর ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, অনেক জায়গায় বালুর কারণে ব্রিজগুলো হুমকির মুখে পড়ছে, তাই দ্রুত প্রতিবেদন দিতে হবে।

সভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসক বলেন, দাগনভূঞার দাদনা খালসহ গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে আগামী বর্ষার আগে ফেনীতে জলাবদ্ধতা না থাকে।

সভায় জেলা প্রশাসক তার তিন বছর মেয়াদি অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের কথা উল্লেখ করে প্রতিটি দপ্তর ও জেলার উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা এবং তা বছরব্যাপী তা বাস্তবায়নে সকলকে আহ্বান জানান। এর মধ্যে রয়েছে খাস জমিতে বৃক্ষরোপণ, খেলাধুলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা ও সুশাসন, পরিবেশ সংরক্ষণ, ডিজিটাল কার্যক্রম, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহ বিভিন্ন খাত।

খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেনী জেলায় ২ হাজার ১৮৯ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজার ৬৯২ মেট্রিক টন সংগ্রহ হয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৭ শতাংশ। আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন। এরমধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ৫৭০ মেট্রিক টন।

জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়ে বলেন, খাদ্যবান্ধব ভোক্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী ইউনিয়ন পর্যায় থেকে বাড়াতে হবে, যাতে কৃষকরা লাভবান হন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।

সভায় স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সিভিল সার্জন ড. রুবাইয়াত বিন করিম বলেন, মেডিকেল বর্জ্যের জন্য আলাদা ডাম্পিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমন জায়গা নির্ধারণ করতে হবে যেখানে পাখি বা অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে, যাতে বর্জ্য অন্যত্র ছড়িয়ে না পড়ে। বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন তিনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পৌরসভাকে নির্দেশনা দেন।

আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, সামনের সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর, প্রবেশ পথ এবং বাহিরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

তিনি বলেন, দাউদপুলের পরের এলাকা মাদকের হাব হিসেবে পরিচিত, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সেখানে ঝুঁকি বেশি। ওই এলাকায় কতটি পরিবার থাকে সেটিকে কেন্দ্র করে জরিপ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযানের অনুরোধ জানান তিনি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রোমেন শর্মার সঞ্চালনায় সভায় সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সকল সরকারি দপ্তরের দপ্তর প্রধান, জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন।