সপ্তাহের ব্যবধানে ফেনীতে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ টাকা। গত সপ্তাহের শুরুতে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল ৮০ টাকা, মাঝামাঝি বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকায়, এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। এতে প্রতিদিন ফেনী বাজারে প্রায় দুই লাখ কেজি পেঁয়াজ বিক্রির বিপরীতে ন্যূনতম ২০ টাকা করে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, যা মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এই বিপুল অঙ্কের টাকা প্রতিদিন ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তবে এর দায় নিচ্ছেন না কেউ।
গতকাল সোমবার (১০ নভেম্বর) ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, ফেনীতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। ফেনী বড় বাজারের আড়ৎ থেকে এসব পেঁয়াজ ফেনীসহ আশপাশের জেলাতেও সরবরাহ করা হয়। পেঁয়াজের সংকট, বৃষ্টি, সংরক্ষণে সমস্যা ও আমদানি না হওয়াতে দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন পেঁয়াজ সরবরাহকারীরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানায়, ফেনীর বড় বাজারে মোট ১৩ জন আড়তদার পেঁয়াজ, আলু ও আদার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে হাজী ইদ্রিস এন্ড সন্স, আল্লাহর দান, রাজু এন্টারপ্রাইজ, হাজী জালাল, আয়েশা ট্রেডার্স, ভক্তি রঞ্জন সাহা, হরিপদ সাহা, ফৌজিয়া ট্রেডার্স ও মদিনা ট্রেডার্স অন্যতম।
হাজী মো. ইদ্রিস মিয়া এন্ড সন্সের সত্ত্বাধিকারী বেলায়েত হোসেন বলেন, এখন মৌসুম শেষ, যোগানও কম। ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে না। পেঁয়াজের উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বেড়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দাম কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে।
তিনি বলেন, ফেনীতে আগে ৩০০ টন পেঁয়াজ আসত, যা ফেনীসহ আশেপাশের জেলায়ও যায়। এখন প্রতিদিন ২০০ টনের কম আসে। পচনশীল পণ্য হওয়ায় বছরে শেষ দিকে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়। প্রতি ৪০ কেজি থেকে পাওয়া যায় ৩২-৩৩ কেজি। এতে খরচ বাড়ে, পণ্য কমে সংকট তৈরী হয়।
ব্যবসায়ী আব্দুল মতিন পারভেজ বলেন, ভারতের আটটি রাজ্যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, তাই তারা সারা বছর টিকে থাকে। আমাদের দেশে একবারই উৎপাদন হয় শীতকালে। এখন কৃষকের কাছেই পণ্য নেই, সরকারও আমদানি করছে না। ফলে দাম বেশি।
তিনি বলেন, জানুয়ারির শেষ নাগাদ বাজারে দেশি পেঁয়াজ আসবে তখন দাম কমে আসবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অক্টোবরে দাম বাড়তে শুরু করে, নভেম্বর-ডিসেম্বরে কেজি প্রতি দাম ১০০ টাকার বেশি হয়। পরে ভারত থেকে আমদানি করেই দাম কমানো হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত একাধিক ধাপে পেঁয়াজের হাতবদল হয়। প্রতিটি ধাপেই মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা করে। তাদের এই অতি মুনাফার কারণেই মৌসুমে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়।
পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন জেলাগুলো পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মেহেরপুরে সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে বিপুল পরিমাণ আগাম পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এটিও মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নভেম্বর ডিসেম্বর কেন্দ্রিক দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইদ্রিস মিয়া এন্ড সন্সের সত্ত্বাধিকারী বলেন, এসব পেঁয়াজ জানুয়ারিতে বাজারে এসেছে। তবে বছর শেষে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। এতে বাজারে বছর শেষে সংকট দেখা দেয়, এতে এ দুইমাসে দাম বাড়ে।
বড় বাজারের ভাই ভাই স্টোরের সত্ত্বাধিকারী হাসান বলেন, বগুড়া, নাটোর থেকে পেঁয়াজ আসে, কিন্তু সেখানে বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ। মুহুরী কাটা পেঁয়াজও আসেনি। ব্যাপারীরা সংকট দেখিয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছে, সরবরাহ কম করছে।আমরা পাইকারি দরে ৯৭ থেকে ১১০ টাকায় পেঁয়াজ নিচ্ছি। ফেনীর মোকাম বড়, চাহিদা অনেক, কিন্তু সরবরাহ কম। ফলে দাম বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ী মোর্শেদ আলম বলেন, গত সপ্তাহে ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০ টাকা বেড়েছে। প্রতিবছর এ সময়ে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়, বাজারে যে দাম তার থেকে ৫-৬ টাকা বেশি দামে আমরা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করি।
স্কুল শিক্ষক জাফর উদ্দিন বলেন, প্রতি পণ্যেই ১০-২০ টাকা করে বাড়তি। একেকজন ভোক্তার পকেট থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ টাকা কাটা যাচ্ছে। সরকার বা প্রশাসনের তদারকি নেই বলেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আসাদ মিয়া জানান, বাজার আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। মৌসুম শেষ হওয়াতে বাজারে পেঁয়াজের কিছুটা সরবরাহ কম। এরমধ্যে ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউ দামে কারসাজি করছে কিনা সেটি আমরা বাজার মনিটরিং এ প্রতিনিয়ত দেখছি। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে দামে কারসাজি করার চেষ্টা করলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, কৃষক থেকে বাজারে আসা অব্দি বিষয়গুলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দেখার সুযোগ নেই। সেটির জন্য কৃষি বিপণন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগ রয়েছে। সে জায়গায় কোন কৃত্রিম সংকট করা হচ্ছে কিনা সেসবের জন্য সম্মিলিত চেষ্টা চালাতে হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মনিরা হক বলেন, বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। যেহেতু অভিযোগ পেয়েছি, বাজার তদারকি করে কোন অসঙ্গতি পেলে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
