আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরের শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে তারা অধিকাংশ সময়ই থাকেন নানা অবহেলায়। প্রাথমিকের শিক্ষকরা শিশুদের হাতে কলম ধরান, শিক্ষার ভিত গড়ে দেন, কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় ভোগেন নানা সীমাবদ্ধতায়। সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে, পর্যাপ্ত বেতন সুবিধা না থাকায় ঋণের বোঝা নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় হতাশায় ভুগছেন তারা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর সূত্র জানায়, ফেনীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫৯টি। জেলায় এসব বিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষক কর্মরত। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে অনেক স্কুলেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার মানে সবচেয়ে বড় চাপ এসে পড়ে শিক্ষকদের কাঁধেই। এছাড়াও শিক্ষকদের বিভিন্ন দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, শিক্ষক রাজনীতি, নারী শিক্ষকদের আধিক্য, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও শিক্ষার্থীদের পারিবারিক শিক্ষার অভাবের কারণে সমাজে শিক্ষকদের কদর কমে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে জেলার একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক ফেনী। তাদের কথায় উঠে এসেছে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থানের নানা চিত্র।

জেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এম সাহাব উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকরা সামাজিক মর্যাদা যতটুকু পাওয়ার কথা, তা তারা পান না। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এমনটি হচ্ছে। এখন শিক্ষিত-অশিক্ষিতদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। গ্রামের একজন সাধারণ ছেলে আয়-রোজগার করে নিজেকে অনেক কিছু মনে করে, শিক্ষকদের প্রাপ্ত সম্মান সামাজিকভাবেই দেওয়া হয় না।

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা কেন কমেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষকদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। ইতোপূর্বে ৬৫ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগ হত। পুরুষ শিক্ষক কম হওয়ায় সামাজিকভাবে অবদান রাখার সুযোগ কমে গেছে। নারীরা স্কুল শেষে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে যান, তারা সামাজিকভাবে অবদান রাখার সুযোগ পান না। এটিও একটি বড় কারণ সামাজিকভাবে শিক্ষকদের কদর কমে যাওয়ার।

তিনি বলেন, সদর উপজেলায় প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষক নারী। কোটার কারণে তারা সুযোগ বেশি পেয়েছেন। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন নারী, ৩ জন পুরুষ। নারীদের আধিপত্যের কারণে প্রাথমিক শিক্ষকদের আগে যেমন মানুষ চিনত, সম্মান করত এখন সেটি নেই। অনেকেই জানেন না তার এলাকায় শিক্ষকতায় কে কে আছেন। আগামীতে নিয়োগের এ নীতি পরিবর্তন হলে হয়তো সামাজিক অবস্থান ফিরে আসবে। আমাদের চাওয়া হলো, সামাজিকভাবে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের জীবনে অনেক কিছু হতে হবে না, সামাজিক অবস্থানটা পেলে আমাদের জীবনই সফল।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার আলোকদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নূরুল মোস্তফা, যিনি দীর্ঘদিন সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষাপদ্ধতি অপরিকল্পিত আধুনিকায়নের ফলে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান কমে গেছে। মানুষ এখন আর্থসামাজিকভাবে উন্নত হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষকদের বেতন কম। তাই মূল্যায়নও কম। বর্তমানে যেসব শিশুরা প্রাথমিকে আসছে, তাদের মায়েরা আধুনিক যুগের। অতীতে মায়েরা যেভাবে পারিবারিক শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের লালন করত, এখনকার মায়েদের মধ্যে সেটি দেখা যায় না।

তিনি বলেন, ওয়ার্ডের একজন মেম্বার কম শিক্ষিত হয়েও সামাজিক যে মর্যাদা পান, তার থেকে অধিকতর শিক্ষিত হয়েও শিক্ষকরা তা পান না। শিক্ষকদের শুধু বেতন বাড়ালেই মর্যাদা বাড়বে তা নয়, শিক্ষকদেরও আরও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা যেমন জন্ম নিবন্ধন করতে শিক্ষকদের স্বাক্ষর প্রয়োজন এমন ক্ষমতা ন্যস্ত করা গেলে মর্যাদা আরও বাড়বে। তখন মানুষ সম্মানের চোখে দেখবে।

ফেনী রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. তৌহিদুল ইসলাম তুহিন বলেন, বর্তমানে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ, শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াসহ নানা কারণে সমাজে শিক্ষকদের অবস্থান অবক্ষয় হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পারিবারিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। আমাদের পাশের দেশগুলোতে শিক্ষকদের মর্যাদা অনেক বেশি। আমাদের দেশেও এটি নিশ্চিত করা জরুরি।

অন্যদিকে শিক্ষকদের মর্যাদার অবক্ষয়ের জন্য শিক্ষকদের গাফিলতি ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করাও অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দেখছেন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মহি উদ্দিন খন্দকার।

প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে প্রশাসনিকভাবে আমাদের কিছু দুর্বলতা আছে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা দায়িত্বশীল নন। অনেক শিক্ষিকা দায়সারাভাবে কাজ সেরে বাসায় চলে যাচ্ছেন। আমাদের পাঠদানের যে সংস্কৃতি, সেটিও এখন আগের মতো নেই। আগে পড়ালেখার জন্য পারিবারিকভাবে একটি শিক্ষা ছিল, এখন সেটি নাই। নতুন কারিকুলামের কারণে মানুষের শিক্ষকদের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, মহিলা শিক্ষিকার ব্যাপকতার কারণে সামাজিক অবস্থান কমে গেছে। কারণ, মহিলাদের নানা সমস্যা থাকে, বৃহৎ অংশের শিক্ষিকারা সময় পার করে চাকরি চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এসব বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছি। সামাজিক মর্যাদা কমে যাওয়ার এটি অন্যতম বড় কারণ।

শিক্ষকদের সম্মানহানির অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক অবক্ষয় বড় কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষকদের অবহেলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পারিবারিক শিক্ষারও অভাব আছে। ফলে শিক্ষকরা আগে যে সম্মান পেতেন, এখন সেটা পাচ্ছেন না। অনেক শিক্ষার্থী মোবাইলে আসক্ত, শিক্ষক সামনে দিয়ে গেলেও সম্মান করে না।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফিরোজ আহাম্মদ বলেন, শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান কিংবা বেতন বৃদ্ধি এগুলো অধিদপ্তর ও মন্ত্রনালয়ের বিষয়, মাঠপর্যায়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাজ করার সুযোগ নেই। পাশাপাশি জেলায় যে শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে সেগুলো নিরসন চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে তা সামাধান হবে।

বেতনের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নেই

শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, তাদের বেতনভাতা ও পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। একজন শিক্ষককে চাকরিজীবনের বেশিরভাগ সময় একই গ্রেডে থাকতে হয়। অবসরে গিয়েও তারা কাক্সিক্ষত সম্মান পান না।

একজন শিক্ষক মাসে যত টাকা আয় করেন, পরিবার নিয়ে চলতে তাকে নানামুখী হিমশিম খেতে হয়। প্রতিমাসে টানতে হয় ঋণের বোঝা।

একাধিক শিক্ষক বলেন, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী একটি সাধারণ পরিবারে বাসা ভাড়া, সন্তানদের খরচ, সংসার খরচ, ঔষধপত্রসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার প্রয়োজন পড়ে। পরিবারের সদস্যসংখ্যা ভেদে এ খরচ আরও বাড়তে পারে। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সর্বোচ্চ বেতন পান ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। শুরুর দিকে বেতন পান ১৮-১৯ হাজার টাকা। এতে প্রতিমাসের ব্যয় মেটাতে কারও কারও ১৫-২০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হচ্ছে। যা প্রতিমাসেই টানতে হচ্ছে শিক্ষকদের।

জেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এম সাহাব উদ্দিন বলেন, প্রধান শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডের বেতন পান। এতে একজন শিক্ষক শুরুর দিকে সর্বোচ্চ ১৮-১৯ হাজার টাকা বেতন পান। এ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। এ বেতন দিয়ে সামাজিক মর্যাদা বজায় রেখে চলা সম্ভব হয় না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য বিষয় সামলানো প্রায় অসম্ভব।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষকরা কষ্ট পেলেও কাউকে বলতে পারেন না। বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন। শিক্ষকতায় যারা আসে তাদের বেশিরভাগ অতিসাধারণ পরিবার থেকে আসে, অন্য কিছু করার সুযোগ তাদের কম। আমরা ২০১৪ সাল থেকে সহকারীদের গ্রেড বৃদ্ধির আবেদন করে আসছি। আশা করি সরকার তা পূরণ করবে।

ফেনী রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. তৌহিদুল ইসলাম তুহিন বলেন, আমরা যে বেতন পাই, তা দিয়ে চলা সম্ভব নয়। আমাদের চাইতে কম শিক্ষিতরা আমাদের থেকে বেশি বেতন পায়। এতে আমরা মানসিকভাবেই পিছিয়ে যাই, কাজের আগ্রহ নষ্ট হয়। প্রতিমাসে আমি ৩৮ হাজার টাকা বেতন পাই, এরপরেও সন্তানের অসুখ হলে ধারদেনা করে ব্যয় মেটাতে হয়। প্রতিমাসে ঋণ নিতে হচ্ছে। আমাদের অবস্থা দিনে আনি দিনে খাওয়ার মতো।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব মহি উদ্দিন খন্দকার বলেন, আমি ১৯৯০ সাল থেকে চাকরি করছি। বাজারে একটা জিনিসের দাম অন্যদের জন্য যত, আমার জন্যও তত। প্রধান শিক্ষকদের বেতন যেমন কম, সহকারী শিক্ষকদের আরও কম। এ বেতন দিয়ে একজন শিক্ষক সামাজিকভাবে সুন্দরভাবে চলতে পারে না। এটি শিক্ষকদের মানসিকভাবে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। দেশের ৫ শতাংশ শিক্ষক সুন্দরভাবে চলতে পারলেও ৯৫ শতাংশ শিক্ষক নানা কষ্টে দিনযাপন করছেন। বর্তমান যে বেতন কাঠামো, তা দিয়ে তারা খুব কষ্টে আছেন।

বিকল্প আয় টিউশনি

ফেনীর অনেক প্রাথমিক শিক্ষক সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন। এরপর বিকেল নামতেই ছুটেন টিউশনি বা কোচিং সেন্টারে। মূল চাকরির আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হওয়ায় অতিরিক্ত আয়ের জন্য তারা বাধ্য হচ্ছেন শ্রেণিকক্ষের বাইরেও পড়াতে।

ফেনী শহরের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ফেনীকে বলেন, আমার মাসিক বেতন দিয়ে বাজার, বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা কিছুই মেলে না। বিকেলে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াই। না করলে সংসার চলত না।

অন্যদিকে গ্রামের অনেক শিক্ষক ক্ষেত-খামারের কাজে জড়িয়ে পড়েন। ছাগলনাইয়ার নিজকুঞ্জরা গ্রামের এক শিক্ষক বলেন, স্কুল শেষে আমি বাড়িতে গিয়ে অন্য কাজ করি। একটি গরু আছে, সেটির দেখাশোনা করি। দুধ বিক্রি করি। এটা না করলে সংসারের খরচ মেটানো সম্ভব হতো না।

জেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাহাব উদ্দিন বলেন, ব্যয় মেটাতে না পেরে অনেক শিক্ষক টিউশনি করছেন। শিক্ষিকাদের খুব একটা প্রয়োজন না পড়লেও অনেক শিক্ষক যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। এতে টিউশনি করতে বাধ্য হন।

তিনি বলেন, প্রাথমিকের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। একজন সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পাবেন। এটি দিয়ে চলবে না। অন্য চাকরির তুলনায় অবসর সুবিধাও কম। এটি প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য কষ্টকর।