‘ফেনী কলেজে অতিরিক্ত ফি আদায়: নির্দেশনা অমান্য করে উন্নয়ন ফি’র নামে দ্বিগুণ টাকা আদায়’ শিরোনাম দৈনিক ফেনীতে গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ফেনী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার। এতে প্রকাশিত সংবাদের একাধিক অংশে ‘ভ্রান্ত তথ্য’ ছিল বলে দাবি করা হয়েছে। লিখিত প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় পুনরায় তথ্য বিশ্লেষণ করেছে প্রতিবেদকসহ দৈনিক ফেনী টিম।
নির্দেশনা অমান্য করে অতিরিক্ত
ফি আদায় হয়নি বললেন অধ্যক্ষ
‘নির্দেশনা অমান্য করে উন্নয়ন ফি’র নামে দ্বিগুন টাকা আদায়’ শিরোনামে দৈনিক ফেনীতে গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ফেনী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে উন্নয়ন ফিসহ কোনো খাতেই দ্বিগুণ বা অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়নি। গত ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা পরিপত্রে উন্নয়ন ফিসহ বিভিন্ন খাতে নতুন হার নির্ধারণ করা হয়। উক্ত পরিপত্রে কার্যকর হওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ না থাকায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নতুন অর্থবছর ২০২৫-২৬ শুরুর (১ জুলাই ২০২৫) সময় থেকে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অতএব, কোনোভাবেই দ্বিগুণ টাকা আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়। এক টাকাও অতিরিক্ত অর্থ আদায় হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্তি ফি বিশ্ববিদ্যালয়ের জারিকৃত পৃথক নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্বের ন্যায় আদায় করা হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, কলেজের বেসরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্নতা এবং দখলীকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত মামলার ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং নিরাপত্তা ও অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী খাতে পূর্বের চেয়ে প্রয়োজনীয় ফি বৃদ্ধি পাওয়ায় একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে ১০০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বৃদ্ধি সম্পূর্ণভাবে সরকারি পরিপত্র অনুমোদিত এবং নীতিমালা অনুযায়ী করা হয়েছে।
প্রতিবাদে উল্লেখ করা হয়, কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার, বিশ হাজার নয়। প্রতিটি বর্ষে ফি আদায়ের সময় খাতওয়ারি বিবরণী বিভাগীয় প্রধানদের সরবরাহ করা হয়। প্রতিবেদনে বস্তুনিষ্ঠতা না থাকায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
উন্নয়ন ফি আদায় পুরনো নিয়মে,
পরীক্ষা ফি নতুন পরিপত্র অনুযায়ী
‘ফেনী কলেজে অতিরিক্ত ফি আদায়: নির্দেশনা অমান্য করে উন্নয়ন ফি’র নামে দ্বিগুণ টাকা আদায়’ শিরোনামে দৈনিক ফেনীতে বুধবার (২৯ অক্টোবর) প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে পুনরায় অনুসন্ধান করেছে প্রতিবেদক এবং সহযোগী দল। দৈনিক ফেনীকে পাঠানো প্রতিবাদে বলা হয়েছে, ফেনী কলেজে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন পরিপত্র কার্যকর হয়েছে। তবে, অনুসন্ধানে দেখা গেছে একই বর্ষের (স্নাতক ২য় বর্ষ) ২০২২-২৩ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উন্নয়ন ফি নেওয়া হয়েছে পুরাতন পরিপত্র অনুযায়ী, পরীক্ষা ফি নেওয়া হয়েছে নতুন পরিপত্র অনুযায়ী। অর্থাৎ, পরিপত্রের কিছু অংশ বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে ১ জুলাইয়ের আগেই।
দৈনিক ফেনীতে প্রকাশিত সংবাদে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ২২ এপ্রিল ২০২৫ জারিকৃত পরিপত্র অনুযায়ী, উচ্চ মাধ্যমিক ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উন্নয়ন তহবিল বাবদ প্রতি শিক্ষার্থী ১০০ টাকা করে শুধুমাত্র একবার (১ম বর্ষে) আদায়যোগ্য বলা হয়েছে। কিন্তু ফেনী সরকারি কলেজের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের (২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ) দুই হাজার ৩৪৬ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উন্নয়ন ফি আদায় করা হয়েছে দুইবার।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নতুন পরিপত্রের ৫ম পাতার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, পূর্বের (৬ জুলাই ২০১৪) পরিপত্র এতদ্বারা বাতিল ঘোষণা করা হলো এবং নতুন আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, প্রকাশের পর থেকে এর বাস্তবায়নে কোনো বিলম্বের সুযোগ নেই। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে এপ্রিল মাসে জারিকৃত পরিপত্র ১ জুলাই ২০২৫ থেকে বাস্তবায়ন করেছেন বলে জানিয়েছেন, যা ‘অবিলম্বে কার্যকর’ নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের নিরীক্ষা অধিশাখায় যোগাযোগ করা হলে সূত্রটি জানায়, অবিলম্বে বাস্তবায়ন বলতে জারিকৃত পরিপত্র মোতাবেক নির্দেশিত কাজগুলো তখন থেকেই শুরু হবে।
এছাড়াও দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য। পুরাতন পরিপত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের থেকে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ফি বাবদ ১৪ পত্রে (সাময়িক ও নির্বাচনী) ৫০ টাকা করে মোট ৭০০ টাকা নেওয়ার কথা। ১৯ মে ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ২য় বর্ষের সেশন ফি বিবরণীতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৯০০ টাকা। যেখানে নতুন পরিপত্র অনুযায়ী প্রতিপত্র ৬০ টাকা করে ১৪ পত্রে ৮৪০ টাকা হওয়ার কথা। অর্থাৎ নতুন পরিপত্রের চেয়ে অতিরিক্ত ৬০ টাকা বেশি আদায় করা হয়েছে।
অধ্যক্ষ প্রতিবাদে জানিয়েছেন, উন্নয়ন ফি পুরাতন পরিপত্র অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, একই বর্ষের (২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের) ২ হাজার ৩৪৬ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরীক্ষা ফি আদায় করা হয়েছে ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত নতুন পরিপত্র অনুযায়ী। অর্থাৎ একই বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি পরিপত্র ব্যবহার হয়েছে। শিক্ষার্থীদের থেকে উন্নয়ন ফি পুরাতন পরিপত্র অনুযায়ী নেওয়া হলেও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ফি নতুন পরিপত্র অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে।
অধ্যক্ষের দাবি অনুযায়ী নতুন পরিপত্র ১ জুলাই ২০২৫ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হলেও কলেজের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নতুন পরিপত্রের আলোকে ফেনী সরকারি কলেজের অভ্যন্তরীণ বন্টন নীতিমালা কার্যকর হয়েছে ১১ আগস্ট ২০২৫ থেকে, যা অধ্যক্ষ বর্ণিত সময়ের প্রায় দেড় মাস পর।
অধ্যক্ষ প্রতিবাদে উল্লেখ করেছেন কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার, বিশ হাজার নয়। প্রতিটি বর্ষে ফি আদায়ের সময় খাতওয়ারি বিবরণী বিভাগীয় প্রধানদের সরবরাহ করা হয়। তবে ফেনী সরকারি কলেজের সরকারি ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খাতওয়ারি ফি আদায়ের কোনো নোটিশ বা প্রকাশ্য বিবরণী সেখানে নেই।
কলেজের একাধিক বিভাগীয় প্রধান জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা সোনালী ব্যাংক সেবার মাধ্যমে টাকা জমা দেন, খাতওয়ারি বিবরণী বিভাগে সবসময় সরবরাহ করা হয় না। আবার সরবরাহ করলেও সেটি শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের কাছে কোন খাতে কত টাকা নেওয়া হচ্ছে তা জানার সুযোগ থাকে না। কারণ, তারা বিভাগভিত্তিক কত টাকা সেটিই কেবল দেখতে পায় অনলাইনে। বাকি তথ্য জানতে বিভাগে কিংবা প্রশাসনিক ভবনে যেতে হয়, যা অনেকের যাওয়ার সুযোগ থাকে না। শিক্ষার্থীরা টাকা জমা দেওয়ার পর পে-অর্ডার দিতেই বিভাগে আসে। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে হলে নোটিশ কলেজের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা প্রয়োজন।
আব্দুল কাইয়ুম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি মাস্টার্স শেষ পর্বে (প্রাইভেট) ভর্তি হয়েছি। সেশন ফি দেওয়ার সময় শুধুমাত্র কত টাকা সেটি উল্লেখ ছিল, কোন খাতে কতটাকা তা দেখার সুযোগ ছিল না। আমরা ভর্তি হওয়ার আগে বিভাগে যেতে পারি না, সোনালী সেবার মাধ্যমে টাকা দিয়ে পে অর্ডারটি কেবল জমা দিয়ে আসি। সেক্ষেত্রে খাতওয়ারী টাকার তথ্য দেখার সুযোগ থাকে না।
অন্যদিকে, অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ এনামুল হক খোন্দকার প্রতিবাদে দাবি করেছেন, ফেনী সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। তবে কলেজের একাডেমিক রেকর্ড অনুযায়ী একাদশ শ্রেণিতে ১ হাজার ৩৫০, দ্বাদশ শ্রেণিতে ১ হাজার ৪০০, স্নাতক (পাশ)-এ ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষে যথাক্রমে ২ হাজার ৪০, ১ হাজার ৬৮০ ও ১ হাজার ১১৩ জন, স্নাতক (সম্মান)-এ ১ম থেকে ৪র্থ বর্ষে যথাক্রমে ২ হাজার ৪৩৫, ২ হাজার ১০০, ১ হাজার ৯০০ ও ১ হাজার ৫০০ জন, স্নাতকোত্তর (প্রিলিমিনারি) শ্রেণিতে ৮৩৬ এবং স্নাতকোত্তর (শেষবর্ষ) শ্রেণিতে ১ হাজার ৫০০ জনসহ মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৮৫৪ জন।
তবে, এটি শুধুমাত্র চলমান শিক্ষাবর্ষগুলোর রেজিস্ট্রেশনকৃত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। বাস্তবে স্নাতক (পাশ), স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর প্রতিটি পর্যায়ে একইবর্ষে একসঙ্গে পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকে। যেমন এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ চলাকালীন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির নিয়মিত ক্লাস চলমান থাকে। অনার্সের বিভিন্ন বর্ষে একযোগে ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নতুন বর্ষের ভর্তি সম্পন্ন হয়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে, আগের ব্যাচের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে। ডিগ্রি ১ম বর্ষ ভর্তি চলমান এবং আগের সেশনের নির্বাচনী পরীক্ষা চলমান। এসব হিসাব বিবেচনায় কলেজে বিভিন্ন ফি জমাদানকারী শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও বেশি।
অধ্যক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী খাতে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থী থেকে অতিরিক্ত প্রায় ১৭ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। ১৭ হাজার শিক্ষার্থী থেকে ৭৫০ টাকা হারে টাকা নিলে সেই পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কর্মচারী খাতসহ অন্যান্য খাতে খরচ হয় ৮০ লাখ টাকা। অধ্যক্ষের দেওয়া শিক্ষার্থীর হিসেবেও উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিবেদক বলেন, প্রতিবেদনে অধিভুক্তি ফি ১০০ টাকা উল্লেখ করা হয়েছিল, যা অধ্যক্ষের প্রতিবাদেও মেনে নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিবেদনে বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করা হয়নি এবং তাতে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে, দৈনিক ফেনী অসত্য সংবাদ প্রকাশ হতে বিরত থাকে এবং তথ্য ব্যতীত সংবাদ পরিবেশন করে না। বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদ প্রকাশ করাই দৈনিক ফেনীর স্লোগান। সংবাদটি ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সরকারি পরিপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
