বাংলাদেশের প্রখ্যাত আমলা, চিন্তাবিদ ও লেখক কাজী ফজলুর রহমান মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ও সচিব এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। গত শনিবার মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। মৃত্যুকালে ফজলুর রহমান চার মেয়ে ও এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কাজী ফজলুর রহমানের জীবন ছিল মেধা, নৈতিক সাহস ও মানবিক সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রশাসন, সামাজিক সংস্কার, সাহিত্য ও জাতীয় উন্নয়নে তাঁর অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করে যাবে।

মরহুমের মেয়ে দূরীন শাহনাজ গণমাধ্যমকে জানান, ১৯৩২ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণকারী ফজলুর রহমান ছিলেন তার প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমলা ও জন-বুদ্ধিজীবী। শৈশবকাল থেকেই তিনি বাংলাদেশ-প্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের সেবায় নীরব কিন্তু দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিলেন।

মরহুমের ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বর্তমানে তার মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। মরহুমের সন্তানরা দেশে আসার পর আজ সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) বাদ আসর ঢাকার ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের বায়তুল আমান মসজিদে প্রথম জানাজা হবে। পরদিন মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) বাদ জোহর দুপুরে ছাগলনাইয়ার পূর্ব শিলুয়ায় কাজী বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

জানা গেছে, ১৯৩২ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণকারী কাজী ফজলুর রহমান ছিলেন তাঁর প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমলা ও জনবুদ্ধিজীবী। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের সেবায় নীরব কিন্তু দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ। অসাধারণ মেধা, কৌতূহল ও শৃঙ্খলার পরিচয় দিয়ে তিনি মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পড়াশোনার জন্য পরিবার ছেড়ে নিকটবর্তী শহরে যান এবং বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে অবস্থান করেন—যা তাঁর আজীবনের আত্মনির্ভরতা, দৃঢ়তা ও উদ্দেশ্যবোধের প্রথম প্রমাণ। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মেধার স্বাক্ষর স্পষ্ট ছিল; তিনি এসএসসি ও এইচএসসি—উভয় বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন, যা তাঁকে তাঁর সময়ের অন্যতম মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, যেখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মাস্টার অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (ঈঝঝ) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনকারী প্রথম বাঙালি হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে শুরু হয় এক দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল প্রশাসনিক জীবন, যা কয়েক দশক ধরে উপমহাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাঁর নেতৃত্বে গৃহীত গণশিক্ষা কর্মসূচি ও সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে এবং এর জন্য তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার লাভ করেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (অউই) বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক হিসেবে উন্নয়ন প্রশাসন, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিষয়ে কাজ করেন।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সেচ, বন ও পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সমূহের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন।

সরকারি দায়িত্বের বাইরে তিনি সামাজিক ন্যায় ও মানবকল্যাণে ছিলেন গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তিনি ব্র্যাকের প্রথম পরিচালনা পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, রাড্ডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টারের চেয়ারম্যান—যেখানে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি একটি টেকসই সামাজিক উদ্যোগে রূপ নেয়—এবং এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সভাপতি ছিলেন, যার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে, এবং গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

একজন বহুলপঠিত ও প্রখ্যাত লেখক হিসেবে তিনি স্মৃতিকথা, প্রশাসন, উন্নয়ন ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৩০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত দিনলিপি সিরিজ আমলার দিনলিপি এবং দিনলিপি একাত্তর প্রজন্মের পর প্রজন্মের আমলা ও গবেষকদের জন্য অপরিহার্য পাঠ্য, যা বাংলাদেশের প্রশাসন, নৈতিক নেতৃত্ব এবং ইতিহাসের অন্তর্গত জীবনচিত্র তুলে ধরে।

তিনি প্রয়াত লিলি রহমানের স্বামী; লিলি রহমান ছিলেন একজন সমাজসেবী ও দানবীর, যিনি ২০১৪ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি চার কন্যা, এক পুত্র ও দশ নাতি-নাতনিসহ এক বৃহৎ পরিবার রেখে গেছেন, যারা তাঁর সততা, সেবা ও মানবিকতার মূল্যবোধ বহন করে চলেছেন।