বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক ও পরিবেশগত এলাকা। এই উপজেলা একদিকে যেমন বিস্তৃত কৃষিভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ, তেমনি অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন এবং পরিবেশগত ঝুঁকির সম্মিলিত হুমকিতে একটি সংকটাপন্ন জনপদে পরিণত হচ্ছে। এখানে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি সুরক্ষিত রাখতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি বড় বাঁধ বা পানি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে মুছাপুর ক্লোজার ও মুহুরী প্রকল্প।
এই বাঁধ কেবলমাত্র নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখে না, এগুলোর ভূমিকা বহুমাত্রিক। একদিকে যেমন মিঠা পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষিকাজে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে লবণাক্ততার প্রসার রোধ করে কৃষি জমির উর্বরতা বজায় রাখে। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে জনপদ রক্ষায় এই বাঁধদ্বয় একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো কাজ করে। এর পাশাপাশি, স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও এদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
তবে দুঃখজনকভাবে আজ এই দুটি প্রকল্পই চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একদিকে, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, যার ফলে নদীর তলদেশে ভারসাম্য হারিয়ে বাঁধের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, বাঁধ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতির কারণে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কাজ সময়মতো সম্পন্ন হচ্ছে না। এই অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার ফলে বাঁধগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং দুর্যোগের সময় কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে না। তদুপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও নদীর পানিপ্রবাহের অনিয়মিততা বেড়ে যাওয়ায় এই বাঁধগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে বহুগুণে।
ফলে, সোনাগাজী উপজেলার জনজীবন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এখন একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন জরুরি পদক্ষেপ—বাঁধ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা, নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো উন্নয়ন। তবেই কেবল এই অঞ্চলকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের বিবরণ
২০২৪ সালে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে মুছাপুর ক্লোজার সম্পূর্ণ ধসে পড়ে। এতে প্রায় ২০,০০০ হেক্টর ফসলি জমি ডুবে যায়, হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে স্থানীয় মৎস্য ও কৃষি অবকাঠামো ধ্বংস হয়, বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়, শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই ঘটনাটি দেখিয়ে দেয় যে, আমরা যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেই, তাহলে মুহুরী প্রকল্পও একই পরিণতির শিকার হবে।
অবৈধ বালু উত্তোলন : বহুমুখী ঝুঁকিতে জনপদ
মুছাপুর ক্লোজার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় পানি যেমনি দায়ী অবৈধ বালু উত্তোলনও অন্যতম প্রভাবক। নদী থেকে বালু উত্তোলনের বহুমাত্রিক ক্ষতি রয়েছে। সোনাগাজীসহ বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে অবৈধভাবে নদীর গভীর থেকে বালু উত্তোলন আজ এক ভয়াবহ পরিবেশগত অপরাধে পরিণত হয়েছে। কিছু অসাধু চক্র স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন নদী ও পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে।
১. বাঁধ ও ক্লোজারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে
নদীর তলদেশ থেকে যখন অপরিকল্পিতভাবে ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়, তখন নদীর প্রাকৃতিক তলচূড়া বা বেড ধীরে ধীরে নিচে নেমে যায়, অর্থাৎ নদী গভীর হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ও তলদেশের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়। নদীর ধার ঘেঁষে যেসব বাঁধ নির্মিত থাকে, সেগুলোর ভিত্তি সাধারণত নদীর তলদেশের উপর নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু যখন তলদেশ থেকে বালু সরিয়ে ফেলা হয়, তখন বাঁধের নিচের অংশ বা ভিত্তি ক্রমশ ফাঁপা হয়ে পড়ে বা খালি হয়ে যায়। ফলে বাঁধের নিচে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয় যা বাঁধের কাঠামোগত স্থায়িত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করে। এই ফাঁপা জায়গা ভেঙে গিয়ে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে পড়তে পারে। বিশেষ করে বর্ষাকালীন সময়ে পানির অতিরিক্ত চাপ, স্রোতের গতি, অথবা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে এই দুর্বল ভিত্তির বাঁধ হঠাৎ করে ভেঙে যেতে পারে।
২. নদীভাঙন ও ভূমি ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়
নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে শুধুমাত্র নদীর গভীরতা নয়, বরং নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বা প্রবাহপথও বিঘ্নিত হয়। নদীর তলদেশ থেকে অতিরিক্ত বালু সরিয়ে নেওয়ার কারণে নদীর তলদেশ অসমতল হয়ে পড়ে এবং স্রোতের গতি ও দিক পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পরিবর্তিত স্রোত নদীর একপাশে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, ফলে তীরবর্তী মাটি ক্ষয় হতে থাকে এবং নদীভাঙন শুরু হয়।
৩. নদী তলদেশের ইকো সিস্টেম ধ্বংস হয়
নদী থেকে বালু উত্তোলন একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা, যার প্রভাব নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমের উপর মারাত্মকভাবে পড়ে। যখন নদীর তলদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে বালু তুলে ফেলা হয়, তখন সরাসরি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বা স্পনিং গ্রাউন্ড ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক প্রজাতির মাছ নদীর তলদেশের নির্দিষ্ট অংশে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা জন্মায় এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি নির্ভর করে তলদেশের মাটি, গঠন, জলপ্রবাহ ও তাপমাত্রার ওপর। কিন্তু বালু তুলে ফেলার ফলে এসব ক্ষেত্র ধ্বংস হয় এবং মাছের প্রজনন চক্র ব্যাহত হয়।
এছাড়া নদীতে থাকা বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ, যেমন শৈবাল, পদ্ম, পানিফল বা অন্যান্য জলজ গুল্ম-লতাও বালু উত্তোলনের কারণে মারা যায়। এদের শিকড় নদীর তলদেশে গেঁথে থাকে এবং তারা জলজ প্রাণীর জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও অক্সিজেন উৎপাদনের উৎস হিসেবে কাজ করে। এসব উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে গেলে নদীর খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। ফলে, এই ইকোসিস্টেমের উপর নির্ভরশীল জীবজগৎ বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পরিবেশ হারিয়ে ফেলে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে স্থানীয় জেলেদের জীবিকার উপর। নদীর মাছ কমে গেলে তাদের দৈনন্দিন আয় কমে যায়, জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, এবং পরিবার পরিচালনায় চরম সংকট তৈরি হয়। অনেক সময় তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হতে হয়, যা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে।
এই পরিস্থিতি শুধু একটি পেশার লোকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং একটি পুরো এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই নদী থেকে বালু উত্তোলনের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত না হলে, তা দীর্ঘমেয়াদে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে আমাদের ঠেলে দিতে পারে।
৪. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়
বালু হলো মাটি ও পানির চক্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান, যা ভূমির জলধারণ ক্ষমতা ও পানির প্রাকৃতিক ছাঁকন (ফিল্টারিং) ব্যবস্থায় বড় ভূমিকা পালন করে। নদীর তলদেশে বা ভূ-উপরিভাগে থাকা বালুর স্তর বৃষ্টির পানি ও নদীর পানিকে শোষণ করে এবং ধীরে ধীরে সেই পানি ভূগর্ভে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বা একুইফার স্বাভাবিকভাবে পূরণ হয়, যা মানুষের নলকূপ, ডিপ টিউবওয়েল ও সেচকাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জলাধার হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু যখন অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে নদীর তলদেশ বা ভূ-উপরিভাগ থেকে বালু তুলে ফেলা হয়, তখন সেই প্রাকৃতিক ছাঁকন প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে। বালু না থাকায় বৃষ্টির পানি বা নদীর পানি দ্রুত গতিতে বয়ে যায় এবং মাটির নিচে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
এ অবস্থায় পানির প্রয়োজন মেটাতে আরও গভীর নলকূপ বসাতে হয় বা ডিপ টিউবওয়েলের গভীরতা বাড়াতে হয়, যা কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেচকাজে পানির ঘাটতি দেখা দিলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়, ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। এমনকি অনেক সময় কৃষকেরা ফসল ফলাতে নিরুৎসাহিত হয়, যা তাদের জীবিকায় সরাসরি আঘাত হানে।
এই অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও ভয়াবহ গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ে, এবং পানি-নির্ভর পরিবেশব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এছাড়া জলাধার শুকিয়ে যাওয়া ও একুইফারের অতিরিক্ত নিঃসরণ স্থানীয় পরিবেশেও তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূলতা তৈরি করে।
অতএব, বালুর প্রাকৃতিক ভূমিকা শুধুমাত্র ভূমি গঠনে সীমাবদ্ধ নয়, এটি পানি সংরক্ষণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও কৃষি টেকসই রাখার অপরিহার্য উপাদান। এই বাস্তবতা অনুধাবন করে বালু উত্তোলন কার্যক্রমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে।
৫. আর্সেনিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে মানুষ বাধ্য হয়ে আরও গভীর স্তর থেকে পানি তুলতে শুরু করে, বিশেষ করে কৃষিকাজ, পানীয় জলের সরবরাহ ও শিল্পকারখানার প্রয়োজনে। কিন্তু এই গভীর স্তরের পানির সঙ্গে অনেক সময় প্রাকৃতিকভাবে মিশে থাকে বিষাক্ত ধাতব উপাদান যার মধ্যে অন্যতম হলো আর্সেনিক (ধৎংবহরপ)।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ভূগর্ভস্থ স্তরে আর্সেনিক প্রাকৃতিকভাবে মাটির খনিজ উপাদানের সঙ্গে মিশে থাকে। স্বাভাবিকভাবে তা পানি ব্যবস্থায় সক্রিয় না থাকলেও, যখন গভীর স্তর থেকে অতিরিক্ত হারে পানি উত্তোলন করা হয়, তখন পানির প্রবাহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সেই আর্সেনিক ধীরে ধীরে পানির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে।
এই পানিই যখন মানুষ পান করে বা রান্নার কাজে ব্যবহার করে, তখন দীর্ঘমেয়াদে শরীরে আর্সেনিক জমা হতে থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় আর্সেনিক দূষণ, যা ধীরে ধীরে মানুষের ত্বক, যকৃত (ষরাবৎ), কিডনি, ফুসফুস, এবং এমনকি মস্তিষ্কেও ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী সংস্পর্শে তা ক্যান্সার, ত্বকের ক্ষত, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করে।
ভারতের তামিলনাড়ু ও উত্তর প্রদেশে বালু উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৬ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে কেনিয়া ও নাইজেরিয়ায় কৃষির জন্য পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের মেঘনা, পদ্মা ও মুহুরী নদী এলাকায় গভীর নলকূপে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে
প্রস্তাবনা ও করণীয়:
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার পর এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যথায় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো হলো:
১. বাঁধ পুনর্র্নিমাণ ও শক্তিশালীকরণ:
দ্রুত বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে, যা নদীর প্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং যে কোনো বড় ধরনের বন্যা বা পাহাড়ি ঢল সহ্য করতে সক্ষম হবে। বাঁধের কাজগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে দীর্ঘমেয়াদী ফল পাওয়া যায়।
২. দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা : বাংলাদেশে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং বাঁধ ব্যবস্থাপনায় শৈথিল্য দীর্ঘদিন ধরে একটি সাংগঠনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এই দুইটি ক্ষেত্রের অব্যবস্থাপনার পেছনে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, ঠিকাদার চক্র, দায়িত্বহীন সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা জড়িত থাকার অভিযোগ বহুবার উঠে এসেছে। সুনির্দিষ্ট তদন্তের মাধ্যমে অবৈধ বালু উত্তোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, ঠিকাদার ও পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করা। বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (ইডউই) এর যে সমস্ত কর্মকর্তা অবহেলা বা দুর্নীতির মাধ্যমে এই সংকট সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রশাসনিক ও আইনগত শাস্তির আওতায় আনা। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন, এলজিইডি, ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার ভূমিকাও তদন্তের আওতায় আনতে হবে কারণ স্থানীয় প্রশাসনিক সহায়তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ কার্যক্রম চলতে পারে না। যারা দায়িত্বে থেকেও নিরব থেকেছেন কিংবা মদদ দিয়েছেন, তাদের 'নিষক্রিয়তা'কেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যদি দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় অপরাধীরা বিচার এড়িয়ে যায় ফলে দুর্নীতি সংস্কৃতি গেড়ে বসে এবং জনগণের আস্থা বিনষ্ট হয়। শুধু প্রকল্প বা বাঁধ সংস্কার নয়, তার ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ফলে সমাজে একটি বার্তা যাবে যে— প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনজীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা করা যাবে না।
৩. আধুনিক জাতীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রনয়ন ও কঠোর পরিপালন:
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। দেশের লাখ লাখ মানুষ নদীর পাড়ে বসবাস করে এবং বাঁধের ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবন ও জীবিকা পরিচালিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, পাহাড়ি ঢল, অকাল বন্যা এবং নদীর প্রবাহের অস্থিরতা এখন বাঁধ ব্যবস্থাপনাকে একটি জটিল এবং উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির জন্য এখনো সমন্বিত, সময়োপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাতীয় নীতিমালা অনুপস্থিত।
জাতীয় বাঁধ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা কেন জরুরি?
বিচ্ছিন্ন প্রকল্প ভিত্তিক উদ্যোগ কোনো টেকসই সমাধান দেয় না প্রয়োজন একটি একক ও কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত নীতিমালা, যা দেশজুড়ে বাঁধ ব্যবস্থাপনার মানদণ্ড নির্ধারণ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন অতিবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উষ্ণায়নের ফলে বাঁধের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। মিলিটারাইজড ও দুর্যোগ-সহিষ্ণু নকশা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ সবই একত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে একটি শক্তিশালী নীতিমালায়।
উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি-নির্ভর বাঁধ ব্যবস্থাপনার অনুকরণ জরুরি:
যেমন: নেদারল্যান্ডস বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঁধ ব্যবস্থাপনার উদাহরণ, যেখানে তারা উবষঃধ ডড়ৎশং এর মতো সুপারস্ট্রাকচার তৈরি করেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র হাইড্রোলজিকাল মডেল, সিসমিক ডিজাইন ও রিয়েল টাইম মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করে বাঁধের কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব রক্ষা করে। বাংলাদেশেও এইসব দেশ থেকে টেকনিক্যাল সহযোগিতা, নকশা জ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণ করে বাঁধ নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
বাকি অংশ পড়ুন এখানে-
<span style="fo