প্রথম অংশ  পড়ুন এখানে-

 

৪. বালু উত্তোলনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ:
অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য সিটি করপোরেশন, উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের সাথে সমন্বয় রেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত অভিযান চালানো এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৫. জনসম্পৃক্ততা ও স্থানীয় কমিটি:
জনগণকে সচেতন করা এবং বাঁধ রক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় কমিটি গঠন করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা প্রকল্পের নিরাপত্তার প্রতি আগ্রহী হয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করে বালু উত্তোলনকারী চক্রকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে চিহ্নিত করতে হবে এবং সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে।

৬. প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং ব্যবস্থা:
নদী এবং বাঁধের অবস্থা নিরীক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, স্যাটেলাইট, ড্রোন ও সেন্সর ব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা নদী ও বাঁধের সঠিক অবস্থান এবং পরিবেশগত পরিবর্তন সম্পর্কে নির্ভুল এবং সময়োপযোগী তথ্য পেতে পারি।

১. স্যাটেলাইট প্রযুক্তি:
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নদী ও বাঁধের ভূগোল, অবস্থান ও পরিসীমা নিরীক্ষণ করা যায়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা নদীর পানি স্তরের পরিবর্তন এবং বাঁধের ধ্বংসাবশেষ বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ শনাক্ত করতে পারি। গ্রাউন্ড-স্ট্রিপিং ইমেজিং ব্যবহার করে নদীর ধীর গতির পরিবর্তন এবং বালু উত্তোলনের কারণে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের পরিবর্তনও লক্ষ্য করা সম্ভব। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পাঠিয়ে, সব জায়গায় একযোগভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

২. ড্রোন প্রযুক্তি:
ড্রোন অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপকরণ যেটি নদী এবং বাঁধের স্থায়িত্ব এবং পরিসরের সরাসরি চিত্র ধারণ করতে পারে। ড্রোন ব্যবহার করে নদীর তলদেশ, বাঁধের পাড় এবং অন্যান্য উপাদান পরিদর্শন করা যায়, যেখানে পাখি অথবা স্যাটেলাইট ছবি তুলতে সক্ষম নয়। ৩ডি ম্যাপিং তৈরি করা যায়, যা বাঁধের ক্ষয়, জং ধরানো অংশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থান সনাক্ত করতে সহায়তা করবে।

৩. সেন্সর প্রযুক্তি:
বাঁধের স্থিতিশীলতা এবং নদীর গতিপথ পর্যবেক্ষণের জন্য সেন্সরের ব্যবহারও একটি চমৎকার প্রযুক্তি। সেন্সর ব্যবহার করে বাঁধের চাপ এবং তাপমাত্রা পরিমাপ করা যেতে পারে। এই পরিমাপগুলি বিশ্লেষণ করে বাঁধের সুরক্ষা সম্পর্কিত আগাম তথ্য পাওয়া যায়। পানি প্রবাহ, পলিমাটির প্রবাহ ও ভূগর্ভস্থ পানি স্তর এর পরিবর্তন শনাক্ত করা যায়, যা পরবর্তীতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দেয়।


তথ্য সংগ্রহ এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে শেয়ারিং:
যেহেতু নদী ও বাঁধের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রমের নিয়মিত হওয়া উচিত। এটি করার মাধ্যমে বাঁধের অবস্থান এবং নদীর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক, তাজা তথ্য পাওয়া যাবে। পরিবেশগত পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যেমন নদীতে অতিরিক্ত বালু জমা, নদীর ভাঙন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। এই তথ্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে শেয়ার করা দরকার, কারণ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ড (ইডউই) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে।
তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি হবে, এবং স্থানীয় প্রশাসনও ঝুঁকি মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। এছাড়া, এই ধরনের প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে, তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়, যা স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধী চক্র বা অবৈধ কার্যক্রম যেমন বালু উত্তোলন বা বাঁধ ভাঙার অপচেষ্টা তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। প্রযুক্তি নির্ভর পরিদর্শন ব্যবস্থা এবং তথ্য শেয়ারিং সমগ্র বাঁধ ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে। সঠিক, নির্ভুল এবং সময়োপযোগী তথ্য সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিলে নদী ও বাঁধের অবস্থা আরও সুদৃঢ় এবং জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মুছাপুর ক্লোজার ও মুহুরী প্রকল্পের পরিস্থিতি আজ একটি বড় হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীভাঙন, অবৈধ বালু উত্তোলন এবং দুর্নীতির কারণে এই বাঁধদ্বয় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বিশেষ করে, মুছাপুর ক্লোজারের সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত, যা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এক জরুরি আহ্বান।স্থানীয় জনগণের জীবন ও কৃষি ব্যবস্থা রক্ষার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বাঁধের পুনর্র্নিমাণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর আইন প্রয়োগ, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা, এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাঁধ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা উচিত। শুধু প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নয়, বরং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণও একান্ত প্রয়োজন। এই অঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একমাত্র তাৎক্ষণিক এবং সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। তাই, আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সোনাগাজী উপজেলাকে একটি নিরাপদ এবং টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্মও এই প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে উপকৃত হতে পারে।
লেখক-
গবেষক ও চিন্তক