বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষাকে জাতির উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষিত জাতি গড়ার যাঁরা কারিগর, সেই এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা আজও নানা সংকটে জর্জরিত।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবদান

দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান ভরকেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরাই গ্রামের দরিদ্র, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছেন। অল্প বেতন, সীমিত সুযোগ-সুবিধা, অবহেলিত অবস্থা—তবুও তাঁরা প্রতিদিন নিরলসভাবে পাঠদান করে যাচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার স্বপ্নে। অথচ তাঁদের জীবনযাত্রার মান আজ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। তিন দফা দাবিতে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এতে সারা দেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী অংশ নেন। কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি তাঁরা। লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। তাঁদের তিনটি দাবি হলো শিক্ষক ও কর্মচারী উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা, মুল বেতনের ২০% বাড়ি ভাড়া এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।

বাড়ি ভাড়ার বাস্তবতা ও যৌক্তিক দাবি-

বর্তমানে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি বহুগুণে পেয়েছে । বিশেষ করে বাসা ভাড়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শিক্ষক সমাজের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অসহনীয় বোঝা। অনেক শিক্ষক শহর বা উপজেলা সদরে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে পরিবার থেকে দূরে থেকে ভাড়া বাসায় থাকেন। কিন্তু এমপিওভুক্তদের বর্তমান বাড়ি এতটাই কম যে তা দিয়ে এক মাসের ভাড়ার অর্ধেকও মেটে না। এই বাস্তবতায় ২০% হারে বাড়ি ভাতা বৃদ্ধি শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়, বরং অত্যাবশ্যক।সরকার যদি সরকারি চাকরিজীবীদের মতোই এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও এই ভাতা নির্ধারণ করে, তবে তাঁদের জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও স্বস্তির হবে।

চিকিৎসা ভাতার মানবিক দিক-

একজন শিক্ষক যখন অসুস্থ হন, তখন ক্লাস বন্ধ থাকে, শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং পরিবারে অনিশ্চয়তা নেমে আসে। অথচ বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মাত্র ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান, যা এক দিনের চিকিৎসা ব্যয়েও যথেষ্ট নয়। আজ একটি সাধারণ রক্তপরীক্ষা, ডাক্তারের ফি, কিংবা প্রাথমিক ওষুধের খরচই এক হাজার টাকার ওপরে। তাই তাঁদের জন্য ন্যূনতম ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা নির্ধারণ এখন মানবিক ও বাস্তবসম্মত দাবি। এই দাবি শুধু অর্থের নয়, এটি একজন মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষার প্রশ্ন।

শিক্ষকদের অবহেলা মানেই জাতির অবহেলা-

শিক্ষক সমাজকে অবহেলা করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহেলা করা। শিক্ষকরা কেবল পাঠদান করেন না; তাঁরা চরিত্র গঠন, নৈতিকতা বিকাশ এবং সমাজে আলোকিত নাগরিক তৈরির কাজ করেন। তাঁদের জীবন যদি দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত থাকে, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থায় উৎসাহ, মানসিক প্রশান্তি ও মানোন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? আর্থিকভাবে নিরাপদ শিক্ষকই তার পেশায় মনোযোগী, উদ্ভাবনী ও দায়িত্বশীল হতে পারেন। তাই শিক্ষকদের ন্যায্য প্রাপ্য দেওয়া মানে দেশের ভবিষ্যৎকে বিনিয়োগ করা।

সরকারের দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা-

বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়তে হলে আগে “স্মার্ট শিক্ষক” তৈরি করতে হবে—যাঁরা আত্মসম্মান ও ন্যায্য প্রাপ্য নিয়ে বাঁচবেন।

সরকারের পক্ষ থেকে যদি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ২০% বাড়ি বাড়া ও ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা অনুমোদন করা হয়, তবে তা হবে শিক্ষা খাতের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁদের প্রতি সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও সহায়তার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। কারণ একজন শিক্ষক গড়ে ওঠেন সমাজের সহযোগিতায়, আর সমাজ গড়ে ওঠে শিক্ষকের হাতে।

পরিশেষে—

আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের প্রশাসক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারক। তাঁদের গড়ে তোলেন যাঁরা, সেই শিক্ষকরা যদি আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তবে রাষ্ট্রের উন্নয়নও টেকসই হবে না। তাই এখনই সময় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ—এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি বাড়া ২০% এবং চিকিৎসা ভাতা ১,৫০০ টাকা কর্মচারীদের ৭৫% উৎসব ভাতা নির্ধারণ করে তাঁদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান ঘটান। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান জানানো মানে জাতির ভবিষ্যৎকে সম্মান জানানো।আসুন, আমরা সবাই মিলে বলি—শিক্ষক বাঁচলে দেশও বাঁচবে।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, ফকিরহাট আবু বকর উচ্চ বিদ্যালয় ফেনী সদর, ফেনী ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ), ফেনী জেলা শাখা।