দেশের অন্যতম একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জেলা ইউনিটে সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি গণমুখী সেবা সংস্থা, স্বাভাবিক অর্থে এতে মানুষের আগ্রহ থাকবেই। এবং সংস্থাটি সে সুযোগও রেখেছে অনেকটা 'খোলা বাজারের' মতো করেই। চাইলেই যে কেউ হতে পারবে এর আজীবন সদস্য। কিন্তু সুযোগ থাকলেই সেটি গণহারে ব্যবহার করা কতটা যুক্তিযুক্ত! এটা হতে পারে আমাদের বোঝা অথবা বোধের অভাব। কে, কোন সংগঠন করবে, কেন করবে অথবা কে কী ধরনের সংগঠন বা সংস্থায় সদস্য হবে, এগুলো আমরা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করি না। কোথায় আমাদের আগ্রহ, কোথায় আমি ভূমিকা রাখতে সক্ষম — এসব আমরা হৃদয় দিয়ে বিবেচনা করি না। কোনো একটা সুযোগ সামনে এলেই সেটা লুফে নিতে আমরা উঠেপড়ে লেগে যাই। আদতে সেটি আমার জন্য প্রযোজ্য বা প্রাসঙ্গিক কিনা, এটা নিয়ে ন্যূনতম ভাবি না। ফলশ্রুতিতে বিষয়টির ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না।

আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় একটা কথা আছে — 'ভাগের আড্ডি চাবাই অইলেও হালাই দে', বিষয়টি অনেকটা এরকমই। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অত্যন্ত বড় এবং স্বনামধন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এ সংগঠনকে বলা হয় 'মাদার অর্গানাইজেশন অব ভলান্টারি ওয়ার্ক' — অর্থাৎ সেবামূলক কাজের সবচেয়ে বৃহৎ সংস্থা। সঙ্গত কারণে এখানে সদস্য হবেন জেলার প্রাজ্ঞ, সামর্থ্যবান ও সত্যিকারের সেবা করার মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা। ছাত্র-তরুণদের জন্যও সুযোগ আছে শ্রম ও মেধার মাধ্যমে এর যুব ইউনিটে সম্পৃক্ত হওয়ার। ছাত্র বয়স থেকেই এভাবেই জানি এটিকে।

যেকোনো সংগঠনে নির্বাচনের বিষয় এলে সেটিকে প্রভাবিত করার নানা চেষ্টা-অপচেষ্টা থাকে। কিছু নিয়মের মধ্যে থেকে, কিছু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ফেনী ইউনিটের কার্যকরী পর্ষদেরও নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি চলছে বলে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছি। অতীতে যেমন ঠিক করে দেওয়া হত কারা নির্বাচন করবেন, কারা পদে বসবেন, এবার হয়তো এর কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোটাধিকার প্রয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে (শেষ পর্যন্ত দফারফা হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই)।

স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের সংগঠনে দায়িত্বে আসার কথা শহরের সত্যিকারের সমাজসেবক বা সামাজিক ব্যক্তিত্বদের (হোক রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক)। তবে অতীতের ইতিহাস (পুরোনো বা নিকটবর্তী) পর্যালোচনা করে বোঝা যায় এতে রাজনৈতিক প্রভাব থাকেই — হোক নিয়মে বা অনিয়মে। এক্ষেত্রে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী, যারা নিজ নিজ সংগঠনের 'সবুজ সংকেত' পেয়েছেন অথবা পাবেন বলে প্রত্যাশা, তারা নির্বাচনের আগেই নির্বাচিত হওয়ার পথ সহজ রাখার চেষ্টায় আছেন বলে মনে হয়েছে অনেকের। তাই অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার কিছুটা আগেভাগে নিয়ন্ত্রণ করতেই আজীবন সদস্য হতে (পড়ুন করতে) হিড়িক পড়ে গেছে। কারণ, এ সংস্থার নির্বাচনে ভোটার হতে হলে আজীবন সদস্য হিসেবে নাম থাকা লাগবে।

মূলত নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুকদের ইচ্ছায় তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা 'আজীবন সদস্য' হওয়ার হিড়িকে নাম লেখাচ্ছে বলে অনেকের মতামত দেখলাম। যা গত ক'দিনের শহরের অন্যতম প্রধান খবর। অথচ ৩৩৬০ টাকা খরচ করে এখানের আজীবন সদস্য হতে পারা সম্মানিত বোধ করার পরিবর্তে ভোটাধিকার প্রয়োগ করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে দেখলাম অনেকে। কিছু ভিডিওতে কয়েকজনের বক্তব্য দেখলাম, যারা পর্যাপ্ত ফরমের অভাবে সদস্য হতে পারছেন না বলে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন — সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে নাকি এই অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, আগ্রহী সবাই-ই সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে; সে হিসেবে ফরম আনানোর চেষ্টাও চলছে। তবে তারা আগামী নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারবেন কিনা সেটি নিশ্চিত না। মূলত এ নিয়েই যত হাহাকার।

রেড ক্রিসেন্ট একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে আপনি সদস্য হবেন সে প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করতে, যথাসম্ভব সেবা প্রদান করতে। দেদারসে এতে সদস্য হওয়ার প্রতিযোগিতা যেমন কাম্য নয়, তেমনি কোনো এক শ্রেণির ইচ্ছায় এটি অবরুদ্ধ রাখাও অপ্রত্যাশিত। এ প্রতিষ্ঠান কী কী কার্যক্রম করে, এসব কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয়, সেগুলো আপনি কতটা জানেন, অথবা এ ধরনের কার্যক্রমের সাথে আপনি কতটা সম্পৃক্ত — এ নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত। সদস্য হতে হলে এগুলো জানতেই হবে, বিষয়টি এমনও না। যে কারোই সুযোগ আছে সদস্য হওয়ার। কিন্তু আপনি আসলে এ সংগঠনের সদস্য হওয়ার মতো প্রাসঙ্গিক কিনা, এটাও তো আপনার নিজেকেই অনুভব করা লাগবে।

৩৩৬০ টাকা প্রদান আর ইচ্ছা পোষণ করলেই তো এ সংস্থার সদস্য হওয়া যাচ্ছে, যদি এটাই বিবেচনা হতো তবে এর সদস্য কেন কেবলই ৮০০-তে সীমাবদ্ধ ছিল! এই যে ৮০০ ছিল, তাও তো বেশিই মনে হতো আমার — যা এমনই কোনো নির্বাচনকে ঘিরেই হয়েছে হয়তো। যা গত কয়েকদিনে দ্বিগুণ (১৬০০+) হয়ে গেছে বলে জেনেছি! এর আগে কিংবা এর পরেও তো আজীবন সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকছে, থাকবে। কেন এখনই এ তোড়জোড়!

পাশাপাশি যে বা যারা এ সংস্থার কার্যনির্বাহী পর্ষদে নির্বাচন করতে চায়, তারা কেন বিগত সময়ের মতো নিজ রাজনৈতিক দলের সবুজ সংকেত নিয়ে আসা লাগবে? দলীয় পরিচয় যে কারোই থাকতে পারে। তবে এখানে যার যার ব্যক্তি সুনাম এবং সেবামূলক কাজ করার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই নির্বাচনে আসা উচিত। এমন অনেকেই আছে যারা হয়তো নির্দিষ্ট কোনো দলের কর্মী, তবে সমাজ ও সেবামূলক সংগঠনে বেশ সংযুক্ত — তাদেরই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত দলীয় বিবেচনায়। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রমে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কিন্তু রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, এমন ব্যক্তিদেরও সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

এককথায়, প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিরাই এ সংস্থায় নিয়োজিত হোক। পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে এমনভাবে সাজানো উচিত যেন 'ভোটাধিকার প্রয়োগ'-এর সুযোগে সদস্যপদের যত্রতত্র ব্যবহার না হয়। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এমন একটি সংস্থার আজীবন সদস্য হতে হলে ন্যূনতম কিছু ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত, আগ্রহীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের বায়োডাটা সংগ্রহ করা উচিত এবং কতদিন আগে সদস্য হলে তিনি ভোটার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন সেটিও নির্ধারিত থাকা উচিত।

আগামীতে যারা এ সংস্থার সেবায় নিয়োজিত হবেন, তারা এসব পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করবেন — এই একমাত্র প্রত্যাশা রাখলাম। তবেই হয়তো রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পুরোনো সুনাম ফিরে পাবে, এ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত ও বিপদগ্রস্ত মানুষের নানা সেবায় সেরা সংগঠন হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। শুভকামনা রইল।

লেখক
উদ্যোক্তা ও যুব সংগঠক