সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক ও প্রগতিশীল চিন্তার তরুণ হিসেবে জেলার রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে পর্যবেক্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক। সে পর্যবেক্ষণ থেকেই এ লেখা।
৫ আগস্টের পর থেকেই দ্রুত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে সরব রাজনৈতিক দলের নাম বিএনপি। এর আগে বিগত সরকারের আমলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান দাবী ছিলো তাদের। নির্বাচন নিয়ে সরব হলেও বিভিন্ন আসনে এখনও প্রার্থীতা নিশ্চিত করেনি দলটি। বড় দল হওয়ায় একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ফেনীতেও এর ব্যতিক্রম না। ফেনী-১ আসনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া নির্বাচন করার সম্ভাবনা থাকায় এ আসন ছাড়া বাকি দুই আসন নিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। এরমধ্যে ফেনী-২ অর্থাৎ, সদর আসন নিয়েই যত আলোচনা। গত সপ্তাহজুড়ে এ নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নানা মন্তব্য এবং প্রত্যাশা চোখে পড়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এ বিষয়টি—কে হচ্ছেন ফেনী-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী। একই আসনে ইতোমধ্যে এককপ্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিস শুরা সদস্য জেলার প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া এবং এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুর মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে স্ব স্ব দল। জোটবদ্ধ হলে এবি পার্টিকে এ আসন ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি—এমন রাজনৈতিক গুঞ্জনও রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা নেই বলে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছে দলের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। অভ্যুত্থান পরবর্তী সৃষ্ট নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ আসনে এখনও দলের প্রার্থী নির্ধারণ করেনি।
দলীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন দপ্তরের ভাগ-বাটোয়ারায় প্রভাব বিস্তার কেন্দ্র করে এ আসন সবসময়ই হট ইস্যু। তাই এ আসনে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর নানা অবদান তুলে ধরে কয়েকটি ভাগে সক্রিয় রয়েছে জেলার জাতীয়তাবাদী পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। অনেকেই শান্তি ও সহাবস্থান রাজনীতির প্রতীক হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবেদিনকে (ভিপি জয়নাল) আবারো প্রার্থী হিসেবে চাইছে। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বর্তমান এ উপদেষ্টা এখনও ফেনীর উত্তরাঞ্চলসহ জেলার গণমানুষের সর্বাধিক পরিচিত ও আস্থার প্রার্থী বলে মনে করেন তার অনুসারীরা। বিগত সরকারের আমলে তাঁর বাড়িতে হামলাসহ নানা নির্যাতনের কথা তুলে ধরছেন তারা। এছাড়াও নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও দলীয় সকল কার্যক্রমে তিনি উপস্থিত ছিলেন বলে তাদের দাবী। কিন্তু আরেকটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি তাঁর ঘোর বিরোধিতা করছেন। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে এবং দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে তাঁকে পাওয়া যায়নি বলেই ওই অংশের অভিযোগ। তাদের দাবী এ আসনে আসুক নতুনমুখ। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা রাখা এবং সর্বাধিক নিপীড়িত নেতাদের থেকেই তারা ফেনী-২ আসনে বিএনপির নতুন সংসদ সদস্য প্রার্থী দেখতে চায়। এ অংশটি আবার দুইভাগে বিভক্ত। একটি ভাগ জেলা বিএনপির বর্তমান সদস্যসচিব এবং বিগত সময়ে দলীয় প্রতীকে ফেনী পৌরসভার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আলাল উদ্দিন আলালকে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রত্যাশা করছে। বিএনপি অধ্যুষিত শহরের রামপুরসহ জেলার বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা তাঁকে যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করছেন। অনুসারীরা তাঁর নানাবিধ কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত তুলে ধরছেন। রাজনৈতিক ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে, প্রান্তিক মানুষের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা আলাদাভাবে তুলে ধরছেন তারা। বিগত সরকারের আমলে নির্যাতন, কারাভোগ ও আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় ভুমিকায় ছিলেন বলে কর্মীদের দাবী। যদিও দলের একটি অংশ তাঁকে সংসদ সদস্য হিসেবে নয়, ফেনীর মেয়র হিসেবে চায়। সংসদ নির্বাচনে নতুনমুখ দেখতে চাওয়া আরেকটি অংশ অবশ্য জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি গাজী মানিককে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে দেখছেন। গত ১৭ বছর বিরোধী দলের আন্দোলনে সবচেয়ে কার্যকর ভুমিকা রাখতে গিয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি কারাভোগ এবং নির্যাতিত হয়েছেন বলে মনে করেন অনুসারীরা। এছাড়াও বিপুল মামলার শিকার ‘আপসহীন নেতা’ হিসেবে দলের ভেতরে ও বাহিরে তার আলাদা খ্যাতি রয়েছে বলে দাবী করেন আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাওয়া তৃণমূলে তাঁর সমর্থকরা। তবে জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার সম্ভাবনা থাকায় ফেনী দক্ষিনাঞ্চলের এ নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে চুড়ান্ত মনোনয়ন নাও পেতে পারেন বলে কর্মীদের অনেকের ধারণা।
এ তিনজন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ আসনটিতে আরও বেশ ক’জন মনোনয়ন প্রত্যাশি রয়েছেন, যাদের প্রায় সকলেই আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ও নির্যাতনের শিকার। এরমধ্যে জাতীয় নির্বাহী কমিটি সহ প্রশিক্ষণ সম্পাদক ও সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু, নির্বাহী কমিটির সদস্য মশিউর রহমান বিপ্লব রয়েছেন। ধানের শীষের হয়ে তারা ফেনী সদর আসনে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। দলের তরুণ-যুবদের পছন্দের নেতা জেলা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, জেলা কমিটির আহবায়ক শেখ ফরিদ বাহারও রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে। সব মিলিয়ে হাফ ডজন প্রার্থী রয়েছে আগ্রহী তালিকায়। একটা বিষয় খেয়াল করে দেখলাম, সবার মধ্যে যে ২-৩ জন আলোচনায় এগিয়ে তাদের কর্মীদের বেশিরভাগই দুটো বিষয়কে উপস্থাপন করে নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত। একটি হচ্ছে বিগত সময়ে কে বেশি মামলায় আক্রান্ত এবং কে বেশী কারাবরণ করেছেন। আরেকটি হচ্ছে, দুঃসময়ে কাকে কর্মীরা সবসময় পাশে পেয়েছে। এ দুই বিবেচনায় তারা নিজ নিজ প্রার্থীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নিজেদের ফোরামে কথা বলছেন এবং অন্য প্রার্থীর বিরোধিতা করছেন।
কিন্তু দলের হাই কমান্ড বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আসলে কোন বিবেচনায় ‘একক’ মনোনয়ন নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন? কি কি কর্মকাণ্ড তারা পরখ করছেন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে? এক্ষেত্রে কেবলই নির্যাতিত বা দলের কার্যক্রমে ভূমিকা রাখাকে বিবেচনায় নেবেন নাকি ব্যক্তি ক্লিন ইমেজ, নাকি ভিন্ন কিছু?

দলীয় কমিটিতে পদ দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত যে বিবেচনা করা হয়, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ঠিক করতে গিয়ে নিশ্চয়ই আরও কিছু বাড়তি কিছু ভাবনায় সংযুক্ত করা হয়, করারই কথা। গত ২৬ অক্টোবর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ অঞ্চলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ডেকে নেন গুলশান কার্যালয়ে। এ খবরে আগ্রহীদের অনুসারীরা যার যার নেতার মনোনয়ন প্রায় চুড়ান্ত বলে সামাজিক মাধ্যমে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও তাদের সবার পছন্দের প্রার্থীরা ফিরে আসেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ভার্চুয়ালি ‘ঐক্যের বার্তা’ সাথে নিয়ে।
দলীয়পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিগত সময়ে দলের আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখা, নির্যাতিত হওয়া বা কর্মীদের খোঁজ রাখা প্রাধান্য পাওয়া উচিত নিশ্চয়ই। কিন্তু জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনার পাশাপাশি আরও নানা যোগ্যতা দেখার প্রয়োজন নেই কী?

বিশেষ করে ৫ই আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে একজন প্রার্থীর কেবলই নির্যাতিত হবার ইতিহাসই যথেষ্ট নয়। কেননা তৃণমুল নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে কম বেশি সব নেতৃবৃন্দই নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে নির্বাচিত হতে যাওয়া জনপ্রতিনিধিদের হতে হবে সুস্থ্য রাজনৈতিক চর্চা সম্পন্ন, মুক্তমনা, ইতিবাচক এবং সূদুরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। যার মগজে থাকা লাগবে ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়। দলের চেয়ে গণমানুষের প্রয়োজনের তাগিদকে যিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন, দলের সুবিধা নেওয়া কর্মীর চেয়ে সাধারণ কর্মজীবী মানুষের কন্ঠস্বরের পক্ষে যিনি লড়বেন, তিনিই হবেন আগামীর সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি। তাই বড় দল হিসেবে দলের ত্যাগী নেতার মূল্যায়ণের পাশাপাশি তার নানা সক্ষমতাও বিবেচনায় আনতে চাইবে বিএনপি। কারণ, দেশের এ অস্থির পরিস্থিতিতে জনগণের একটি বৃহৎ অংশ তাকিয়ে আছে গণমানুষের দল দাবী করা এ রাজনৈতিক দলটির দিকে। লন্ডন হতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন বেশ কঠিন হবে। এ নির্বাচনে প্রার্থী বাচাইয়ে নানা বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। বিএনপির তৃণমূলের সাধারণ সমর্থকরাও একই বিষয় উপলব্ধি করেন, এমন একজন প্রার্থী তারা দলের পক্ষে প্রত্যাশা করেন, যিনি দলে অবদানের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য, যার ব্যক্তি ইমেজ ইতিবাচক, অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ, চিন্তা-চেতনায় সৃজনশীল, সুশিক্ষায় শিক্ষিত। কেবলই ত্যাগী বা নির্যাতিত কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য বা সামর্থবান নন এমন কাউকে যেমন তারা প্রত্যাশা করছেন না, তেমনি কেবলই ক্লিন ইমেজ কিন্তু এ জনপদের মানুষের সাথে যোগাযোগ নেই, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ করতে সক্ষম নন এমন কাউকেও তারা প্রার্থী হিসেবে চান না। তবে দলের হাই কমান্ড নিশ্চিত করেছেন, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় ইতোমধ্যে প্রার্থীতা প্রায় চূড়ান্ত, শীঘ্রই নাম প্রকাশ হবে এবং সে প্রার্থী যেই হোক, তার পক্ষেই অর্থাৎ ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে কাজ করতে হবে দলের নেতাকর্মীদের। রাষ্ট্রের নাগরিক এবং এ আসনের একজন ভোটার হিসেবে আমার চাওয়া আর আট-দশজন সাধারণের মতোই। দলগুলো এমন প্রার্থী বেছে নিক, ভোটাররা যেন ভালো মানুষদের একজনকে তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করতে পারে। অধম কখনো উদাহরণ হয় না, উদাহরণ হতে হয় উত্তমকে।

-উদ্যোক্তা ও যুব সংগঠক, ফিচার এডিটর, দৈনিক ফেনী