বাংলাদেশের গণমাধ্যম এমন এক জটিল পরিবর্তনযুগে দাঁড়িয়ে আছে যখন সাংবাদিকতার ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং ভিউ ভিত্তিক জনপ্রিয়তার প্রবণতা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত। সাংবাদিকতা ঐতিহাসিকভাবে ছিল সত্য অনুসন্ধানের একটি কঠিন শিল্প এবং একটি প্রকারের সামাজিক দায়িত্ব যা ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, দুর্বল মানুষের পক্ষে দাঁড়ায় এবং সমাজকে সঠিকভাবে তথ্য জ্ঞানে সক্ষম করে। কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তার সাংবাদিকতাকে এমন এক দৌড়ে নিয়ে এসেছে যেখানে সত্য প্রায়ই দ্বিতীয় সারিতে চলে যায় এবং সামনে আসে দর্শকসংখ্যা নামক নতুন শক্তি। দশ বছর আগেও সাংবাদিকরা প্রতিবেদনের গভীরতা, বিশ্লেষণ এবং প্রেক্ষাপটকে অগ্রাধিকার দিতেন। এখন একটি সংবাদ কতজন দেখল, কতবার শেয়ার হলো এবং কত দ্রুত ভাইরাল হলো সেটাই নির্ধারণ করছে সংবাদটির মূল্য। এই পরিবর্তন শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং কাঠামোগত। গণমাধ্যম এখন আগের মতো জনস্বার্থের তথ্যবাহক নয়; বরং একটি বাজার যেখানে তথ্য পণ্য আর পাঠক বা দর্শক ক্রেতা। এই বাজারে প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায়শই নিজেদের নৈতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে ভিউ নিশ্চিত করার পথে হাঁটছে। এই পরিবেশে সত্যের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে এবং সমাজের তথ্য গ্রহণের ক্ষমতা বিভ্রান্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

সাংবাদিকতার এই বিচ্যুতির সবচেয়ে বড় উপাদান হলো চটকদার শিরোনামের প্রভাব। শিরোনাম একসময় প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করত। ভাষার সংযম, তথ্যের সারাংশ এবং পাঠকের বোধগম্যতার সমন্বয়ে একটি শিরোনাম তৈরি হতো। আজ সেটি হয়ে গেছে ব্যবসায়িক হাতিয়ার। বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপোর্টালের শিরোনামগুলোতে দেখা যায় নাটকীয়তার অতিরঞ্জন। এমন শিরোনাম তৈরি করা হয় যাতে পাঠকের মধ্যে তীব্র কৌতূহল জন্মে এবং সে ক্লিক করতে বাধ্য হয়। শিরোনাম দেখে মনে হয় পৃথিবীতে অভূতপূর্ব কিছু ঘটে গেছে, কিন্তু ভেতরের লেখায় পাওয়া যায় অগভীর, অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য। এই ক্লিকবেইট সংস্কৃতি শুধু সাংবাদিকতার নৈতিকতা নষ্ট করছে না, বরং পাঠকের মনেও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। ভিউ ভিত্তিক বাজারে টিকে থাকার জন্য অনেক সংবাদমাধ্যম সত্যের পরীক্ষা না করেই প্রকাশ করে ফেলে একটি অসম্পূর্ণ সংবাদ। বিজ্ঞাপন আয় বাড়ানো এবং পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের এই অস্থির প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে দুর্বল করছে। এই পরিস্থিতিতে শিরোনাম হয়ে উঠেছে একধরনের প্রলোভন, যা মানুষকে টানে কিন্তু তথ্য দেয় না। আর এই আচরণ সমাজে সত্যের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাকে ক্ষয় করছে।

অন্যদিকে অ্যালগরিদম নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রভাব সাংবাদিকতাকে নতুন এক চাপে ফেলেছে। একসময় সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় বোর্ড সিদ্ধান্ত নিত কোন সংবাদটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি জরুরি এবং কোনটি প্রেক্ষাপটসহ তুলে ধরা প্রয়োজন। এখন সেই ভূমিকার একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমগুলো মানুষের আবেগকে কেন্দ্র করে কাজ করে। আবেগ যত প্রবল, কনটেন্টের প্রচার তত বেশি। ফলে সাংবাদিকতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনসমক্ষে পৌঁছাতে পারে না, কারণ তা অ্যালগরিদমের কাছে আকর্ষণীয় নয়। এর পরিবর্তে সামনে আসে উত্তেজনাপূর্ণ ভিডিও, তর্কবিতর্ক, সংঘর্ষ, বিবাদ এবং মানবিক ট্র্যাজেডির ওপর ভিত্তি করে তৈরি সংবেদনশীল কনটেন্ট। সাংবাদিকরা রিপোর্ট লিখতে গিয়ে ভাবেন কোন শব্দ ব্যবহার করলে অ্যালগরিদম সেই খবরকে বেশি ছড়াবে। এতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সংকুচিত হয় এবং সংবাদ নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটি বাজার নির্ভর হয়ে পড়ে। বিশ্লেষণধর্মী লেখা পিছিয়ে যায় আর সংবাদ হয়ে ওঠে সংক্ষিপ্ত, দ্রুত এবং প্রায়শই অতিরঞ্জিত। তথ্যের গভীরতা হারিয়ে যায় আর তার জায়গা দখল করে সহজ বিনোদন ধাঁচের বর্ণনা। এতে সমাজ এক ধরনের ক্ষণিক উত্তেজনার সংস্কৃতির দিকে চলে যাচ্ছে যেখানে মানুষ চমক দেখতে চায় কিন্তু সত্য বুঝতে চায় না। সাংবাদিকতা তখন তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে সংখ্যার খেলায়।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সংকটকে আরও জটিল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রিক সাংবাদিকতার উত্থান। একটি স্মার্টফোন হাতে থাকলেই এখন কেউ লাইভে এসে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়। এরা অনেক সময় ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সংবেদনশীল প্রশ্ন করেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেন এবং মানবিক দুর্ভোগকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরেন। তাদের উদ্দেশ্য সমাজকে তথ্য দেওয়া নয় বরং ব্যক্তিগত পরিচিতি বৃদ্ধি করা। অনেক সময় দেখা যায় কোনো দুর্ঘটনার মুহূর্তে আহত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তারা চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে লাইভ করছেন এবং দর্শকদের আকর্ষণ করছেন। আরও উদ্বেগজনক হলো, তাদের কথাবার্তা এবং উপস্থাপন প্রায়ই আইনি ঝুঁকি তৈরি করে। কোনো ঘটনার তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তারা নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যা আদালত পূর্ব বিশ্লেষণের মতো প্রভাব ফেলে। এই ধরনের লাইভ ভিডিও ভাইরাল হলে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোও সেই প্রবণতাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হয় যাতে তাদের দর্শকসংখ্যা কমে না যায়। এর ফলে সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি যেমন নিরপেক্ষতা, সংযম, মানবিকতা এবং তথ্য যাচাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজ ধীরে ধীরে এক ধরনের নির্মমতাবোধের দিকে এগোতে থাকে যেখানে মানুষের কষ্টকে বিনোদনের উপকরণ হিসেবে দেখা হয়।

ভুয়া তথ্য বা ভুল সংবাদ এই নৈতিক সংকটকে আরও গভীর করেছে। দ্রুততার প্রতিযোগিতায় সংবাদ প্রকাশের আগে সঠিকভাবে যাচাই করার সময় সংবাদমাধ্যমগুলো অনেকবারই নেয় না। ফলাফল ভয়াবহ। একটি ভুল তথ্য কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে, রাজনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে দেয়, এমনকি নিরপরাধ মানুষকে জনরোষের মুখে ফেলে দেয়। কিছু ভুল সংবাদ ব্যক্তিগত জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনে। যদিও পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যম সংশোধনী প্রকাশ করে, কিন্তু সেই সংশোধনী কখনোই আগের ভুল তথ্যের মতো প্রচার পায় না। ফলে মানুষের মনে ভুল ধারণাই স্থায়ী হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ সমাজে ভুল তথ্যের প্রভাব আরও বিপজ্জনক। তথ্যের বিশৃঙ্খলা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে মানুষ বিভ্রান্ত, অনিশ্চিত এবং সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে। সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রবাহের উপর মানুষের আস্থা দুর্বল হচ্ছে এবং তারা ধীরে ধীরে গণমাধ্যম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে অথবা তথ্যের উৎস হিসেবে অযাচাইকৃত প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিচ্ছে যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকানার জটিল কাঠামোও সাংবাদিকতার নৈতিক সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক গণমাধ্যমই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মালিকানাধীন। ফলে সংবাদ নির্বাচনে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যবসায়িক চাহিদা এবং মালিকের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। সাংবাদিকদের অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করা হয়, এমনকি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে প্রতিবেদন করতে বা পক্ষে প্রতিবেদন না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর সাথে যোগ হয় আর্থিক অনিশ্চয়তা, কম বেতন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং নিরাপত্তাহীনতা। সাংবাদিকরা অনেক সময় সত্য তুলে ধরতে পারেন না কারণ তাতে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই বাস্তবতা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কমতে থাকে কারণ অনুসন্ধান করতে সময় লাগে এবং ঝুঁকিও থাকে। মালিকপক্ষ সে ঝুঁকি নিতে চান না, ফলে সাংবাদিকরা নিজস্ব সৃজনশীলতা প্রয়োগ করতে পারেন না। নীরবতার সংস্কৃতি তৈরি হয় যা গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্বকে সংকুচিত করে।

তারপরও এই দীর্ঘ অন্ধকারের মধ্যে আশা রয়েছে। সাংবাদিকতা এমন একটি ক্ষেত্র যা বাজারের চাপে পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না। যত বিভ্রান্তিই ছড়াক, মানুষ সত্যের প্রয়োজন অনুভব করে। সেই চাহিদা থেকেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নতুন সম্ভাবনা জন্ম নেয়। বাংলাদেশে এখনও অনেক সাংবাদিক আছেন যারা নৈতিকতার সাথে সত্য অনুসন্ধান করেন এবং সমাজকে প্রমাণ ভিত্তিক তথ্য দেন। গণমাধ্যমকে এই নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন করতে হবে। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভুয়া তথ্য মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত টুল, ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম এবং মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষার প্রয়োজন। সংবাদমাধ্যমের মালিকদেরও বুঝতে হবে যে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের শক্তি নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। দ্রুত জনপ্রিয়তার উপর নয়। সমাজের মানুষকেও জানতে হবে যে তারা যে তথ্য গ্রহণ করছেন তা সত্য কিনা, যাচাই করা কিনা এবং নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নেওয়া কিনা। যখন গণমাধ্যম সত্যকে অগ্রাধিকার দেবে এবং সমাজ সত্যকে মূল্য দেবে, তখন ভিউয়ের প্রতিযোগিতা স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব হারাবে। সাংবাদিকতা আবারও তার সেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে ফিরে যাবে যেখানে সত্যই সর্বোচ্চ এবং নৈতিক দায়িত্ব পালনই সাংবাদিকতার মূল পরিচয়।