স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরের বাংলাদেশ একটি এমন সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নাম বদলায়, ব্যানার বদলায়, জোট বদলায়, কিন্তু বদলায় না রাজনীতির মনস্তত্ত্ব। আগে ছিল আওয়ামী লীগ বিএনপি; আজ তা রূপান্তরিত হয়েছে বিএনপি জামাতের প্রকাশ্য বাকযুদ্ধের নতুন দ্বন্দ্বে। দুই জোটের ভাঙন, বিরোধ, তিক্ততা দেখে মনে হয় দেশ যেন এক অদ্ভুত চক্রে বন্দি, যার প্রাচীরের নাম ক্ষমতা। দার্শনিক হান্না আরেন্ট বলেছিলেন, “ক্ষমতা কখনো লক্ষ্য নয়; কিন্তু যখন তা একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখনই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।”
বাংলাদেশে কি এখন তাই দেখা যাচ্ছে? মানুষের জীবন, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্রের আদর্শ—সবকিছু যেন ক্ষমতার একমাত্র লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতা কখনোই লক্ষ্য ছিল না; ছিল দায়িত্ব, ছিল আমানত। আল ফারাবি বলেছিলেন, “রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মানুষের নৈতিক উন্নয়ন।” প্রশ্ন হলো, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিই মানুষের নৈতিক বা সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করছে, নাকি জনগণের আবেগ, ইতিহাস, শহীদের রক্ত—সবকিছু মঞ্চের সাজসজ্জা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে?
বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যে তিক্ততা সম্প্রতি বেড়েছে, তা আমাদের সামনে দাঁড় করায় একটি বড় সত্য। রাজনৈতিক দলগুলো কখনো বন্ধু, কখনো শত্রু। সবই ক্ষমতার বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে। কিছুদিন আগেও যারা মাঠে একসাথে আন্দোলন করছিল, আজ তারা একে অপরকে অভিযুক্ত করছে আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলার জন্য। এই অভিযোগ নিজেই একটি ট্র্যাজেডি। কারণ এর মানে হলো, রাজনীতি এখন সত্য ও ভাষার মালিকানা নির্ধারণ করে দেয় দলীয় স্বার্থ অনুসারে।
সত্য বলে পরিচিত হওয়া ভাষাও কেউকে অনুকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশে সত্যের মালিক কে? বিবিসির প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষের বক্তব্য এমনভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত, যে মাঠপর্যায়ে তা হিংসার রূপ নিচ্ছে। জন লক যে সামাজিক চুক্তির কথা বলেছিলেন, রুশো যে জনগণের সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন—সেগুলো কোথায়? জনগণের ভাগ্য কি দলগুলোর তর্কবিতর্ক ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর বন্দি হয়ে গেছে?
বাংলাদেশে রাজনীতি কি ব্যক্তির ওপর দাঁড়ানো, নাকি নীতির ওপর? যদি নীতি হতো, তাহলে বিএনপি জামায়াতের দ্বন্দ্ব নিয়ে দেশ কৌতূহলী হলেও বিভ্রান্ত হতো না। কিন্তু বাস্তবতা হলো দলের নীতি বদলাতে সময় লাগে, ব্যক্তির আবেগ বদলাতে সময় লাগে মাত্র কয়েকটি বক্তব্য। আর সেখানেই আজকের রাজনৈতিক সংকটের গভীরতম জায়গা। তারেক রহমান ভার্চুয়াল বক্তব্য দিচ্ছেন লন্ডন থেকে, আর অন্যদিকে জামায়াতের আমির বলছেন বিএনপি ইতিহাস ভুল ব্যাখ্যা করছে। আবার বিএনপি বলছে জামায়াত আক্রমণাত্মক কথা বলছে। মূল প্রশ্ন হলো, এই কথাগুলো কি জনগণের দুঃখ দূর করতে বলা হচ্ছে, নাকি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে?
টমাস হবস বলেছিলেন, “মানব সংঘাতের উৎস তিনটি—প্রতিযোগিতা, সংশয় এবং আত্মগৌরব।” প্রতিযোগিতা রয়েছে, সংশয় রয়েছে, এবং আত্মগৌরব তো আছেই। তাই সংঘাত অনিবার্যই ছিল। কিন্তু এই সংঘাত কি প্রয়োজনীয় ছিল? স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির ভরকেন্দ্রে থাকা বিএনপি নিজের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুশাসন নিয়ে চাপের মুখে আছে। একইভাবে জামায়াত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইসলামের ধারার অংশ মনে করলেও দুই হাজার তেরোর পর থেকে তাদেরও শক্তি অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে।
উপসংহার হিসাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল উদ্দেশ্য কি জনগণের কল্যাণ, নাকি ক্ষমতার দখল? ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই বিপ্লব, শহীদ পরিবার, দুর্নীতির ইস্যু—সবই ব্যবহৃত হচ্ছে দলীয় স্বার্থের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র কি এভাবে চলতে পারে? কোরআনে আল্লাহ বলেন, “ফিতনা হত্যা অপেক্ষা কঠিন।” এই ফিতনা—অবিশ্বাস, অপবাদ, দোষারোপ—যখন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র ক্ষতবিক্ষত হয়।
আজকের বাংলাদেশের তরুণরা বিভক্ত, বিমর্ষ, ক্লান্ত। তারা দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো আসলে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত; জনগণের স্বপ্ন নিয়ে নয়। ফ্রান্সের রাজনৈতিক দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছেন, “ক্ষমতাই বাস্তবতা তৈরি করে।” বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে বাস্তবতা তৈরি করছে তা হলো দলগুলোর মধ্যকার তিক্ততা, বিভাজন, অবিশ্বাস এবং ক্ষমতার লড়াই। অথচ তরুণদের প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার, নীতিনৈতিকতা এবং আলোচনার সংস্কৃতি। আমরা কি তাদের সেই পথ দেখাচ্ছি, নাকি শেখাচ্ছি কিভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়?
গণতন্ত্রের মূল শক্তি অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু এখানে দলগুলো নিজেদের সমর্থক ছাড়া দেশের বৃহত জনগোষ্ঠীকে ভুলে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “বাংলাদেশের বিরোধীপক্ষ বিভক্ত মতাদর্শের কারণে নয়, বরং নিজেদের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে।” এই নিরাপত্তাহীনতার ভয়, অনিশ্চয়তা এবং আস্থাহীনতা রাজনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু।
অবশেষে প্রশ্ন আসে, সমাধান কোথায়? বাংলাদেশ কি আবারও সেই পুরোনো বিরোধ বিদ্বেষের রাজনীতিতে ডুবে যাবে, নাকি এবার পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হবে? জনগণ জানতে চায়, ক্ষমতার লোভে কি এই সংঘাত, নাকি সত্যিই সেবার মানসিকতার জায়গায় কেউ আছে? ক্ষমতা এবং সেবা এক নয়। একদিকে ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, অন্যদিকে সেবা মানুষকে নম্র করে।
জন লকের ভাষায়, “রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানুষের সেবা করার জন্য, শাসকের সেবা করার জন্য নয়।” কিন্তু আমাদের দেশে শাসকই যেন চূড়ান্ত লক্ষ্য। অন্তবর্তী সরকারের অধীনে দেশের উন্নয়ন ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজও অপরিণত। চলমান বিএনপি জামায়াত দ্বন্দ্ব সেই অপূর্ণতার নির্মম প্রতিচ্ছবি।
এই দ্বন্দ্ব যদি চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে একটি বিভক্ত, অবিশ্বাসী, বিতর্কে ভরা রাষ্ট্র। যেখানে রাজনীতি হবে সংঘর্ষের আর সমাজ হবে সন্দেহের। তাই এখন সময় এসেছে একটি মৌলিক প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার—বাংলাদেশ কি একটি স্থায়ী বিরোধ রাজনীতির দেশ হবে, নাকি যুক্তি, মতাদর্শ, বিবেক ও মানবিকতার রাষ্ট্র হবে?
বাংলাদেশের প্রয়োজন সেই সংস্কৃতি। প্রয়োজন ক্ষমতার রাজনীতি নয়, সেবার রাজনীতি। জনমানুষের কথা শোনা। তরুণদের স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া। দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য, পারস্পরিক সম্মান ও সত্যনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করা। আমরা কি সেই পথে হাঁটব, নাকি আরও ৫৪ বছর পরও আমাদের সন্তানরা লিখবে—আগে ছিল আওয়ামী লীগ বিএনপি, পরে বিএনপি জামাত, কিন্তু একতা কোনোদিনই আসলো না?
:লেখক ও সংগঠক
